ছন্দময় প্রস্থান।
(লন্ডন থেকে)
আমার এই লেখাটি কোন ধর্মীয় আদেশ উপদেশ নয়। কিছুটা অনুরোধ। মনে হয় সুবোধ। এই লেখার উপর কেউ করবেন না ক্রোধ।
আশা করি কোন ব্যক্তি বা ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব আমার উপর রাগ না করে অনুরাগ করবেন। অনুরাগ ভালো।
কোনো বিতর্কে না গিয়ে মনে মনে আমাকে গালিগালাজ করে এড়িয়ে যাওয়া হবে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ। (ভালো না হলেও), অবশ্য, মাঝেমধ্যে গালিগালাজ এলাজের মতো। এলাচ বা এলাচি এলাজের অংশ। ‘এলাজ’ আরবি শব্দ, অর্থ চিকিৎসা।
এলাচ ঔষধি। আনুমানিক চার হাজার বছর ধরে এলাচ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, রোগে ভোগে, ওষুধপত্রে, খানাপিনায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
‘কিছু’টা অপ্রাসঙ্গিক হলেও এলাচ নিয়ে উপকারী একটু বলি।
চরক সংহিতায় আছে-
‘’এলা সূক্ষা কক্ষশ্বাসকাসার্শোমূত্রকৃচ্ছ্বহৃত। রসে তু কটুকা শীতা লস্বী বাতহরী মতা।। (ভাবপ্রকাশ) অর্থাৎ, ছােট এলাচ শীতল ও লঘু গুণ যুক্ত অল্প ঝাঁঝাল স্বাদ বিশিষ্ট এবং বায়ুদোষ নাশক। এই ছােট এলাচ শ্বাস রােগ, অর্শ রােগ, মূত্রকৃচ্ছ রােগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা যায়।
এলাচ মিষ্টি স্বাদ বিশিষ্ট, মুখের রুচিবর্ধক এবং পরিপাক শক্তি বর্ধক। শ্বাস রােগ (এজমা), কাশরােগ এবং মূত্রনালীর সংক্রমণ সারাতে সাহায্য করে, হার্টকে ভালাে রাখে”।
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে আছে, যারা মুখের দুর্গন্ধের সমস্যায় ভুগছে রােজ এলাচের বীজ চিবিয়ে খেলে তাদের উপকার হয়। এছাড়া এলাচের বীজ ঘণ্টা দুয়েক পানিতে ভিজিয়ে রেখে ওই পানি মাউথওয়াশ হিসেবে ব্যবহার করলে মুশকিল আচান। আর দুর্গন্ধ বের হবে না। এই ‘পবিত্র মুখে’ কাউকে গালি দিলেও গালিটি সুগন্ধির মত দেখাবে। সে রাগ করবে না। মনে মনে ধন্যবাদ দিবে। কাছে যেতে চাইবে।
যাক সে সব কথা।
এবার আমার এ লেখার শিরোনামের দিকে একটু নজর দিন।
দেখুন, হিন্দু-মুসলমানের জীবনের শেষ যাত্রায় কী অভাবনীয় ছন্দ- কবরস্থান এবং শশ্মান!
পৃথিবীতে হিন্দু এবং মুসলিম যতই মারামারি করুক না কেন শেষ যাত্রায় তাঁরা মিল রাখেন। এ মিলটিও বা কম কিসের! একজন যাচ্ছেন জান্নাতে, আরেকজন স্বর্গে। রহমান বা ভগবানের সাথে দেখা হবে।
কেউ বলে ‘বিসমিল্লাহ’ কেউ ‘হরিবল’। হুরী বা মেনকার আশা কে না করেন? আমিও করি।
আমরা কবিরা ছন্দ ভালোবাসি। তাই কথাটি এ ভাবে বলা।
কবিরা শুধু কবিতায় নয় জীবনের সবখানে অন্তমিল দেখতে চান। অন্তর মিলের জন্য।
সে হিসেবে আমারও আশা, ছন্দময় শব্দদ্বয়ের মতো এই পৃথিবীতেও এ দুটি জাতি যেন মিলে মিশে থাকে। কবরস্থানে বা শশ্মানে ‘ছন্দ’ রেখে বেশি লাভ নেই। ‘সামাজিক ছন্দ’টা রেখে যেতে পারলে পৃথিবী থেকে জাতিগতদ্বন্ধ অনেকটা মিটে যেত। শান্তির সুগন্ধ বিলাত।
হিন্দু ধর্মে ‘সতীদাহ প্রথা’ পরিবর্তনের পর ব্যক্তিবিশেষে, পরিবারে, সমাজে ও ধর্মীয় বিশ্বাসে এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন ঘটেছে বলে মনে করা যায়। এতে ইতিহাস এবং নারী জাতি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে।
সভ্যতার বিবর্তনের স্বার্থে এই পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল। সতীদাহ প্রথা অব্যাহত থাকলে ধর্মে এবং সমাজে কঠিন প্রশ্ন থেকে যেত।
যে মহান উদ্দেশ্যে সতীদাহ প্রথা তুলে দেয়া হয়েছে, সে একই কারণে কোন কোন স্থানে, কোন কোন কারনে অন্তোষ্টিক্রিয়ায় একটু পরিবর্তন আনা যেতে পারে।
যেই লোকটি পৃথিবীর মায়া-মমতা সংসার অর্থবিত্ত নারী গাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, তাঁর শেষ বিদায়টা কঠিন না করেও আমরা পারি।
জানা যায়, যখন হিন্দুদের শবদেহ দাহ করার জন্য শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন কোন কোন স্থানে মৃত ব্যক্তির পা ভেঙ্গে দেয়া হয়। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এই কাজটি তাঁরা করেন ধর্মীয় বিধান পালনের জন্য।
এই কাজটি তাঁরা ‘হাজার’ বার করতে পারেন। তবে আমি ‘একবার’ অনুরোধ করছি, এই কাজটিতে একটু পরিবর্তন আনা যায় কিনা ভেবে দেখার জন্য।
অবশ্য এ নীতির প্রচলন এখন তেমন একটা নেই।
না থেকে ভালো হয়েছে।
যে লোকটি মারাই গেল তাঁকে দ্বিতীয়বার না মেরে শান্তিতে বিদায় দেয়া যায়।
শবদেহটি এখন নিরাপরাধ। লাশটি পৃথিবীর সকল চাওয়া পাওয়া থেকে মুক্ত। আমাদের প্রতি তার আর কোন দাবি নেই। তার কোনো অনুযোগ নেই। অনুরাগ থাকতে পারে। যে বিশ্বসংসারে এতদিন ছিলেন, সবার সাথে ছিলেন, প্রকৃতির সাথে ছিলেন, তাদের সাথে তাঁর কিছু কথাবার্তা থাকতেই পারে। হয়তো কথাগুলি আমরা বুঝতে পারছিনা। উড়ে বেড়াচ্ছে বাতাসে। শবদেহ এখন সবার আপনজন। তিনি আমাদের মা-বাবা-ভাই-বোন বন্ধু। চির জীবনের স্মৃতি। তাই আমাদের স্মৃতি হবে শান্তির। স্বস্তির। মনে রাখার মত একটি ছবি। কষ্টের ছবি নয়।
অবশ্য, হিন্দু পন্ডিতদের মতে, মাঝেমধ্যে তা করা হয় দাহ করার সুবিধার্থে। কথা হল, শ্মশান প্রশস্ত মাঠে হয়ে থাকে। খোলা মাঠে, নদীর ধারে, বিশাল জায়গা জুড়ে শ্মশানে দুটি পা খোলা রাখার মত জায়গা না থাকার কথা নয়।
চিতার জায়গাকে একটু বড় করলে লাশকে সোজা রাখা যায়, বাঁকা করতে হবে না।
‘সতীদাহ প্রথা’ সংস্কারের মাধ্যমে যদি প্রাণকে রক্ষা করা যায়, একইভাবে ‘শবদাহ প্রথা’ সংস্কার আইন করে ‘শব‘কে সবাই সম্মান করতে পারি।
এ ক্ষেত্রে এমনও হতে পারে, যাঁরা পৃথিবীতে সোজা ছিল তাঁদেরকে সোজা রাখুন। এঁদের কষ্ট দেবার কি দরকার!
এভাবে ব্যক্তি বিশেষে ধর্মীয় বিধানটি প্রয়োগ করা যেতে পারে। এতে কিছু মানুষ রেহাই পাবে। কিছু মানুষ শিক্ষা পাবে। কিছু মানুষ সংশোধন হবে। মরার আগে তাঁরা সোজা হয়ে যাবে। আর বাঁকা করতে হবে না। এভাবে পুরো পৃথিবীটাই সোজা হয়ে যাবে।
একইভাবে মুসলমানের লাশ দাফনের আগে পায়ের
বৃদ্ধাঙ্গুল একটির সাথে আরেকটি বেঁধে দেয়া হয় যাতে সোজা থাকে। কবরে শুইয়ে দেয়া হয় সোজা করে।
যাই হোক, আমরা পৃথিবীতে সোজা থাকার কথা বলছিলাম। মরনের পরে নয়, মরনের আগে আমাদের সোজা হওয়া উচিত। মরনের পরে সোজা হওয়াতে জাতির কোন উপকার নেই।
মুসলমানেরা মৃত লাশকে সামনে রেখে দাফনের আগে উপস্থিত সবার কাছে জিজ্ঞেস করে “লোকটি কেমন ছিল”-? সবাই এক ব্যাক্যে সমস্বরে বলে “ভালো ছিল”।
অনেকেই ডরে ভয়ে বলে “ভালো চিল”। ‘ছ’ এর স্থলে ‘চ’। ‘ছ’ এর স্থলে ‘চ’ উচ্চারণ কেউ জেনে শুনে করেন, কেউ না জেনে করেন। যেভাবেই হোক অর্থটা আর রইল না। ‘চিল’ অর্থ আমরা বুঝি।
অনেকের মুখে ‘ছ’ ‘চ’ হয়ে যায়। কারণ সমাজ এবং পাড়া-প্রতিবেশী জানে সে কেমন ভালো ছিল। যার কারণে গ্রামের মানুষ ঘুমাতে পারতো না, সে নিশ্চয়ই ভাল মানুষ ছিল! কারন, সে সমাজের মানুষকে রাত জেগে জেগে ইবাদত বন্দেগী বা তপজপ করার সুযোগ করে দিত!? তাই অনেকেই বলেন ‘সে ভালো চিল’।
বাপধন, মৌখিক সার্টিফিকেটে কাজ হবেনা। সময় আছে সোজা হয়ে যান।
অহংকার, ক্ষমতার দাপট আর অন্তর ভরা বিষ নিয়ে যারা মানুষকে বাঁকা পথে পরিচালনা করেন, তারা জীবন এবং জগতের ক্ষতির কারণ।
জীবিত অবস্থায় তাদের সোজা করতে না পারলে, হাত পা বাঁকা করা যেতে পারে কিনা দেখুন। জীবিত অবস্থায় তাদের বাঁকা হাত, বাঁকা পা তারা যেন দেখে যেতে পারে। মরনের পরে পা বাঁধা হয় বলে, বাঁকা করা হয় বলে তারা নিজেরা যেমন কিছু দেখে না, জাতিও কিছু শিক্ষা পায় না।
আশা করি আপনিও এবার একটু সোজা পথে চলবেন। আমিও চলবো।
মরনের পর সোজা হলে কোন লাভ হবে না জনাব- মহাশয়। মনে রাখবেন, আজরাইল বা যমদূত কিন্তু ঘুষ নেন না।
আসুন ভালো ভাবে চলি। সোজা পথে চলি। সমাজকে সোজা ও সুন্দর ভাবে গড়ে তুলি। পৃথিবীতে ভালো থাকলে কবরস্থানে বা শ্মশানে বাঁকা থাকাতে কোন সমস্যা হবে না। শাস্তি বা শান্তি বাঁকা সোজার উপর নির্ভর করবে না।
সামাজিক ব্যধি এলাচিতে সারে না। মন্ত্র পাঠ বা ওয়াজ নসিহতে সমাজ উপকৃত হচ্ছে কৈ?
আগে আমাদের নিজের মনকে ভালো করতে হবে শ্মশানে বা কবরস্থানে যাওয়ার আগেই। ভালো হওয়া সহজ। একদম ফ্রী।
কবরস্থান’ ও ‘শ্মশান’ শব্দদ্বয়ের ছন্দ শ্মশানে বা গোরস্থানে যাবার আগে নয়। বিশ্বের প্রয়োজনে দরকার এখনিই।
আমাদের কেন এতো বাড়াবাড়ি কাড়াকাড়ি? কাটাকাটি ফাটাফাটি লাটালাটি?
গোলাগুলি দলাদলি?-
মুসলিম মরলে মাটি হয়,
হিন্দুরা হয় ছাই,
ছাইও জানি মাটি হয়
মনে রেখো ভাই।
পৃথিবীর সব ছাই
হয়ে যাক খাঁটি।
সেইভাবে হোক হোক
খাঁটি সব মাটি।
আমার লেখা একটি চট্টগ্রামের গানে আছে- “অডা বালা হই যা,
বালা হইতে পয়সা খরচ নাই”।
০৯.০৯.২০২১
লন্ডন।
Discussion about this post