কুতুবদিয়া সমুদ্রের বুকে একখন্ড দ্বীপ
কুতুবদিয়া সমুদ্রের বুকে জেগে উঠা একটি দ্বীপ।জানা যায়,পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিকে কুতুবদিয়া দ্বীপে মানুষের পদচারণা ঘটে। হযরত কুতুবুদ্দীন নামে এক কামেল ব্যক্তি তখন আলী আকবর,আলী ফকির সহ বেশ কিছু সঙ্গী নিয়ে মগ পর্তুগীজ বিতাড়িত করে এ দ্বীপে তাঁরা আস্তানা স্থাপন করেন।
অন্যদিকে আরাকান থেকে পলায়নরত মুসলমানেরা
ও চট্টগ্রামের আশে পাশের অঞ্চল থেকে মানুষ ভাগ্যান্বেষণে উক্ত দ্বীপে আসতে শুরু করে।নির্যাতিত মুসলমানেরা কুতুবুদ্দীনের নামানু সারে এ দ্বীপের নাম করণ করেন কুতুবুদ্দীনের দিয়া,যা পরবর্তীতে কুতুব- দিয়া নামে স্বীকৃতি লাভ করে।
এই দ্বীপকে স্থানীয়ভাবে স্থানীয় লোকজন দিয়া বলে থাকে।পরবর্তীতে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন এসে এই দ্বীপে বসবাস শুরু করে।বর্তমানে এই দ্বীপের বয়স প্রায় ৬০০ বছর পেরিয়ে গেছে।
এই দ্বীপের আয়তন প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কমে গেছে সাগরের ঢেউয়ের প্রভাবে প্রতিনিয়ত ভেঙ্গে সমুদ্রে পরিণত হচ্ছে। এই দ্বীপের আয়তন প্রায় ২১৬ বর্গ কিলোমিটার।
এখানে রয়েছে নির্জন বেলাভূমি,বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র,লবণ চাষ,বাতিঘর সহ অনেক পীর আউলিয়ার মাজার।
কক্সবাজার- পেকুয়ার মগনামা ঘাট থেকে কুতুবদিয়া চ্যানেল হয়ে সহজেই কুতুবদিয়া দ্বীপে যাওয়া যায় আবার কক্সবাজার থেকে সরাসরি বোটে বা যাত্রীবাহী নৌযানে করে কুতুবদিয়া যাওয়া যায়।
আমি এই প্রথম কবি বন্ধু আলমগীর হোসাইনের অনুপ্রেরণায় চট্টগ্রাম হালিশহরস্থ ৪০ জন যারা শাহ আবদুল মালেক আল কুতুবী কেবলা জান বাবার ভক্ত তাঁদের সাথে কবর জেয়ারত,জিকির,মিলাদ,কুতুবদিয়া কে সরেজমিনে দেখবো ভেবে চট্টগ্রাম শহর হতে কুতুব দিয়ার দিকে ২১/২/২৩ সকালে রওয়ানা হই।
প্রথমে আমরা চট্টগ্রাম বদ্দারহাট হতে নতুন ব্রিজ এরপর আনোয়ারা বাঁশখালী দিয়ে পেকুয়া মগনামা ঘাট থেকে কুতুবদিয়া চ্যানেল হয়ে কুতুবদিয়া দ্বীপে পৌঁছি।
আমরা যখন দ্বীপে পৌঁছি তখন প্রায় দুপুর ১টা।
আমরা সবাই গাম ভোটে করে (এক ধরনের ইন্জিন চালিত নৌকা)নৌকার মাঝি বারেক মিয়ার সুখ দুঃখের নানা কথা শুনতে শুনতে কুতুবদিয়া দ্বীপে পৌঁছে দেখি চতুর্দিকে লবন আর লবনের চাষ।
চারদিকে তাকাতে দেখি মাঠে মাঠে কৃষকদের লবণ চাষের ব্যস্ততা।
জানা যায়,দ্বীপের সর্বত্রই কম-বেশি লবণের চাষ হয়।
লবণের মাঠ রয়েছে সর্বত্র তবে সবচেয়ে বেশি রয়েছে তাবলের চর,কৈয়ারবিল,আলী আকবরের ডেইল,এসব এলাকায়।
এখানে আসলে প্রাকৃতিক উপায়ে লবণ উৎপাদনের নানান কৌশল দেখা যায়। কাজেই যে কেউ কৌশল জানতে বা শিখতে এখানে সহজে আসতে পারেন।
এছাড়াও লবণের মাঠের পাশে আমি দেখেছি ফসলের ক্ষেত,শাকসবজি,ফল ফলাদির বিশাল আবাদি জমি।
রাস্তার পাশে সবুজ ধান গাছ আর ধান গাছ বাতাসের দোলায় দুলছে আর দুলছে।
যে কথা আমি বন্ধুবর আলমগীরকে বারবার বলছিলাম,আর বলছিলাম সেই কথাটি –
ধন ধান্য পুষ্প ভরা,আমাদের এই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা।
এখানে আসলে দেখা যাবে এখানকার কুতুবদিয়া চ্যানেল।এটি অনেকের মতে বেশ বড়। সারা বছর এই চ্যানেলটি বেশ উত্তাল থাকলেও শীতে মোটামুটি শান্তই থাকে তাই এই শান্ত মৌসুমে কুতুবদিয়া ভ্রমন কাজটি আমি সম্পন্ন করলাম।
এই চ্যানেলে সরাসরি নোঙর করে ফিশিং বোট ও নৌযান। এখানকার বেশিরভাগ এলাকাই বেশ নির্জন মনে হয়েছে।পর্যটকের আনাগোনা তেমন নেই বললেই এখানে চলে।
মাঝে মাঝে শুধু আছে জেলেদের কর্মব্যস্ততা।
এখানে ফিশিং ট্রলার হতে বিভিন্ন জাতের সামুদ্রিক মাছ নামিয়ে কিভাবে বড় বড় পাত্রে ররফ দেয়া হয় তা
কুতুবদিয়া দ্বীপে যাওয়ার পথে স্বচক্ষে আমি দেখেছি।
জানা যায়,এই দ্বীপের আয়তন প্রায় ২১৬ বর্গ কিলো- মিটার। এখানে আসলে দেখা যায় নির্জন বেলাভূমি,বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র,লবণ চাষ,বাতিঘর,সহ অনেক পীর আউলিয়ার মাজার।অনেকের সাথে আলাপ করে জানা যায় এই দ্বীপের বেশিরভাগ লোকজন অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী,শিক্ষিত ও শান্ত।
আমি অনেক দিন থেকে যাওয়ার দিন তারিখ ঠিক করে ব্যস্ততার কারনে আমার পক্ষে তা সম্ভব হয়ে উঠেনি।
২১/২/২৩ মাতৃভাষা দিবস ও সরকার কর্তৃক রাষ্ট্র্রীয় ছুটি থাকায় সেই সুযোগ যথাযত বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করি মাত্র।
আমি ও আলমগীর হোসাইন এই প্রথম,আমরা এই ধরনের আয়োজনে যোগ দিই।কুতুবদিয়া দ্বীপে দুপুর ১ টা পৌঁছে উন্নত সুযোগ-সুবিধার যে অপর্যাপ্ততা রয়েছে তা আমি সহজে টের পাই।
এখানে ভালো কোন রেস্টুরেন্ট আমি দেখেনি।অনেকে বলেছেন, বড়ঘোপ বাজারেই কিছু ভালো রেস্টুরেন্ট রয়েছে তাতে মাছ, মাংস,শুটকি দিয়ে তৃপ্তি নিয়েই খাওয়া যায়।
আমরা মুলত গিয়েছি শাহ আবদুল মালেক শাহ দরবারে।দরবারে গিয়ে নামাজ,জিকির,মিলাদ,জিয়ারত শেষে মেহমান খানা বসে দরবারি খানা খেয়ে আমরা সবাই তৃপ্তির ঢেকুর তুলি।
দরবারি খানা শেষে শাহ আবদুল মালেক শাহ দরবারের আশে পাশে বিভিন্ন স্থাপনা দেখতে গিয়ে ও ঐ এলাকার শিক্ষিত লোকের সাথে আলাপে জানা যায় কুতুবদিয়া উপজেলায় ৬টি ইউনিয়ন রয়েছে।
যেমন- ১নং উত্তর ধুরুং,২নং দক্ষিণ ধুরুং,৩নং লেমশী খালী,৪নং কৈয়ারবিল,৫নং বড়ঘোপ,৬নং আলী আকবর ডেইল।
তাঁরা জানায়,২০১১ সালের এক পরিসংখ্যানে তাঁদের জানানো হয়েছে, কুতুবদিয়া উপজেলার লোকসংখ্যা ১,৩৩,৮৮৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৬৯,৭৩৮ জন এবং মহিলা ৬৪,১৫০ জন।
এ উপজেলার মোট জনসংখ্যার ৯৩% মুসলিম, ৬.৯৬% হিন্দু এবং ০.০৪% বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী রয়েছে। এখানে সাক্ষরতার হার ৭৭%।
এ উপজেলায় ১টি সরকারি কলেজ,১টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ( বালিকা ),১টি টেকনিক্যাল এন্ড বিএম কলেজ,১টি ফাজিল মাদ্রাসা,১টি আলিম মাদ্রাসা, ২টি স্কুল এন্ড কলেজ,৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়,৭টি দাখিল মাদ্রাসা,১টি নিম্ন মাধ্যমিক (বালিকা) বিদ্যালয় ও ৫৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে।
তাহাছাড়া এখানে ৩২টি কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স,৪টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও ৬টি পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র রয়েছে।
এখানকার একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা নৌপথ।
প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম লঞ্চ, স্টীমার, ইন্জিন চালিত ছোট নৌকা এর উত্তর,পশ্চিম ও দক্ষিণ তিন দিকেই বঙ্গোপসাগর এবং পূর্বে কুতুবদিয়া চ্যানেল।ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে কুতুবদিয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকা।
জানা যায়,১৫৬৯ সালের জলোচ্ছ্বাস, ১৭৬২ সালের ভূমিকম্প,১৭৯৫ সালের ঘূর্ণিঝড়,১৮৭২ সালের মহাপ্রলয়,১৮৯৭ সালের জলোচ্ছ্বাস (মগীর তুফান), ১৯০৫ সালের টর্নেডো, ১৯৬০ ও ১৯৭০ সালের জলোচ্ছ্বাসে এ এলাকার হাহার হাজার মানুষ,গবাদি পশুর প্রাণহানি ঘটে এবং ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে কুতুবদিয়া উপজেলার প্রায় ১০ হাজার মানুষের প্রাণ হানি ঘটে,দ্বীপের বিরাট অংশ সাগর বক্ষে বিলীন হয়ে যায়।
কথা প্রসঙ্গে,মানসম্মত খাবার হোটেলের কথা জিজ্ঞাসা
করতে বন্ধুবর সেলিম জানায় থানার আশেপাশে মানসম্মত বেশ কয়েকটি হোটেল রয়েছে। সে জানায়,
এ ছাড়াও সরকারি ডাকবাংলো রয়েছে যেখান থেকে সমুদ্রের সৌন্দর্য সহজে উপভোগ করা যায়।
আমাদের কুতুবদিয়া যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল মালেক শাহ (কুতুবদিয়ার শাহ্ হুজুর) কবর জিয়ারত করা।
জানা যায়,আবদুল মালেক শাহ আল কুতুবী মুহিউদ্দিন আজমী বাংলাদেশের একজন সুফি সাধক ছিলেন।
তিনি ১১ জুলাই ১৯১১ধূরুং, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার জম্মগ্রহন করেন ও ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০০০ চট্টগ্রাম
শহরে মৃত্যু বরণ করেন। মুত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি শিক্ষকতা ও ধর্ম প্রচারে নিয়োজিত ছিলেন।
আমাদের মধ্যে উপস্থিত অনেকে মালেক শাহ কবর কে কবর বলতে রাজি নয়,তাঁদের মতে এটি ওলির মাজার।
আমরা জানি,মুসলমানের দাফনস্থলকেই কবর
বা আভিধানিক অর্থে মাজার বলা যেতে পারে। কবর
বা মাজারে গিয়ে সকল মুসলিমের কবর জিয়ারত করা বৈধ।
অলি-আউলিয়া,বুজুর্গদের দাফনস্থলকে কবর বলা যাবে না মাজার বলতে হবে ইসলামি শরিয়তে এমন কোন বিধান নেই।
কোরআন,হাদিসে কোথাও মাজার শব্দটটি খুঁজেও পাওয়া যায় না।
হাদিসে নবী রাসুলদের দাফনস্থলকে ও কবর বলা হয়েছে।তবে নবী করীম (সা.) এর দাফনস্থলকে ‘রওজা’ বলা হয়। কারণ রওজা শব্দের অর্থ বাগান।
হাদিসে বর্ণিত,নবী করীম (সা.)বলেন, আমার কবরকে তোমরা উৎসবের স্থান বানিও না। তাই বলা যায়, যত সম্মানিত ব্যক্তিই হোক না কেন, তাঁর জিয়ারত করা দোষের কিছু নয়।
বর্তমানে মাজারকে কেন্দ্র করে যেসব কর্মযজ্ঞ চলে তার অধিকাংশই অনেকের মতে শরিয়ত বিরোধী।
যেমনঃ মাজারের নামে মান্নত,সিজদা পশু জবাই, ধনসম্পদ, সন্তানসন্ততি,রোগমুক্তি, সুস্থতা ও সচ্ছলতা ইত্যাদি প্রার্থনা করা।
কেননা, মুসলমানদের বিশ্বাস করতে হবে কল্যাণ,
অকল্যাণের একমাত্র মালিক মহান আল্লাহ।
কেউ যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে সেজদা করে,কারো নাম জপে,কোনো বিষয়ে তার কাছে প্রার্থনা করে, তাহলে তা হবে মুলত শিরক। ইসলামে কবর জিয়ারতের বিধান আছে, কিন্তু কবরকে উৎসবের স্থান বানানোর অবকাশ নেই।
কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্য হল আখিরাতকে স্মরণ করা ও কবরবাসীর জন্য দোয়া করা। এই বিষয়ে নবী করীম (সা.) বলেন, আমি তোমাদের কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। এখন তোমরা জিয়ারত করতে পার। কারণ তা আখেরাতের কথা মনে করিয়ে দেয়।
মাজার জিয়ারত ও কুতুবদিয়া দ্বীপ ভ্রমন শেষে চট্টগ্রাম আসার সময় জেলেদের নিকট হতে কয়েক কেজি সামুদ্রিক মাছ ক্রয়ে আগ্রহ প্রকাশ করলে ও তাতে তারা সাড়া দেয়নি।
এখানে দেখেছি সৈকতের পাশে ঝাউগাছের সারি। কেউ কেউ বলছে,সমুদ্র তীর ধরে একটু দক্ষিণে গেলেই দেখা মিলবে সারিবদ্ধ ঝাউবন,সামুদ্রিক মাছের ছড়া ছড়ি,গাংচিলদের এদিক সেদিক উড়ে বেড়ানোর সেই মনোরম দৃশ্য।
সমুদ্রের কিনারা ঘেঁষে দেখা যাবে শুঁটকি পল্লী,শুঁটকি মহাল।
প্রচুর গাংচিল এখানে ঘুরে বেড়ায়। নির্জনতার সুযোগে সৈকতের কোথাও কোথাও লাল কাঁকড়ারাও দলে দলে ঘুরে বেড়ায় এখানে নির্ভয়ে।
সূর্যাস্তের দৃশ্য সহজে দেখা যাবে ঐ দিন যদি পূর্ণিমার জ্যোৎস্না থাকে তাহলে মনে হবে কুতুবদিয়া যেন স্রষ্টার সৃষ্টি কোন এক অপরূপ স্বর্গ।
নিজকে রাঙ্গাতে,অন্য কাউকে রাঙ্গাতে যে কেউ সহজে ভ্রমন করতে পারে আর সে স্থানটি হতে পারে কুতুবদিয়া সমুদ্রের বুকে একখন্ড দ্বীপ।
লেখক- মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম।
কবি,প্রাবন্ধিক ও গণমাধ্যমকর্মী।
Discussion about this post