গদ্যিকা আজ স্বপ্নময়, অর্থবহ: নতুন ধারার সাহিত্যকর্ম
কালাচাঁদ মৃত্যুঃ
কেবল তপস্যাকঠিন ঐশীবোধসম্পন্ন একজন সুদক্ষ শব্দশ্রমিকই পারেন সর্বাত্মক শিল্পবোধকে খাটিয়ে তাঁর হৃদয়ে কবিভাষা অর্থাৎ ছন্দবদ্ধ ভাষা ধারণ করতে এবং পারেন সুপরিকল্পিত বহুবিধ ছন্দকাঠামো জুড়ে তাঁর অর্জিত সেই ভাষার প্রয়োগ ঘটাতে। আর ছন্দ-কাঠামোয় প্রাণ সঞ্চার করতে পারলেই তিনি হয়ে ওঠেন কবি। একেকটি উপযুক্ত শব্দ খুঁজে এনে উপযুক্ত অবস্থানে বসিয়ে নিজের ভেতরে পুষে রাখা সেই সুপ্ত বোধকে কবিতার প্রতিপর্বে-পঙক্তিতে, রসে, অলঙ্কারে সুসজ্জিত করে যিনি অবেশেষে কবিভাষায় প্রকাশ করতে সক্ষম হন– তিনিই মূলত কবি। অর্থাৎ একবাক্যে বলা যায়– কবিভাষা অর্জন ব্যতীত বিশ্বের কেউ কবি হবার যোগ্যতাই রাখে না।
(ঐশীবোধ এমন একটি বোধ, যা কবিহৃদয়ে ক্ষণকালের জন্য জাগ্রত হয়ে প্রকাশের অপেক্ষায় থাকে মাত্র। কবি যদি উপযুক্ত পত্রে উপযুক্ত সময়ে তাকে কবিভাষা ও ছন্দফ্রেমে বাঁধতে ব্যর্থ হন, সে বোধটিও আর বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না; বরং বিলীন হয়ে যায়।)
শব্দপঞ্জি: একখণ্ড অনির্দিষ্ট জমির উপর একখানা ঘর তৈরীর সমস্ত উপাদান ঢিবি করে রাখা। অথচ একে কেউ ঘর বলছি না– কারণ কী? কারণ এ বস্তুপিণ্ডের কোনো নির্দিষ্ট কাঠামো নেই, এতে ঘরের কোনো কায়া নেই, ছায়া নেই, সীমা-পরিসীমার ছোঁয়া নেই। সামান্যতম চিহ্নটিও নেই যা দেখে উক্ত সরঞ্জামের ঢিবিকে কেউ ঘরের মতো ভাবতে পারে। আসল কথা, ঘরের দৃশ্যে দর্শিত হতে পারে তেমন পরিচয়বাহক কোনো কঙ্কাল-কাঠামো-সদৃশ উক্ত জিনিসগুলো সুসজ্জিত নয়। ঢিবিটায়, ঘর গড়া যেতে পারে তেমন কতগুলো অব্যবহৃত উপাদানই কেবল জড়ো হয়েছে মাত্র। ইচ্ছে করলে এসব দিয়ে অন্যকিছুও গড়া যায়। এবার ভাবুন, ঘর গড়ার সমস্ত উপাদান একত্রে থাকার পরেও কেউ ঘর বলছি না কেন? কীসের কমতি?
গদ্যকর্ম: ঘরটি জমির কোন অংশে তৈরি হবে– এর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতাই বা কী হবে– এর কোনোটাই আপনি নির্ধারণ করলেন না বরং হাতুরি, শাবল, করাত, বাটাল, কোদাল, গাইতি প্রভৃতি যন্ত্রপাতি নিয়ে বিনা মাপজোখে কর্মযজ্ঞ শুরু করে দিলেন! অসঙ্খ্য অসম উচ্চতা-নিম্নতা বিশিষ্ট খুঁটি, দৌড়, ধাওয়া, পাইর প্রভৃতি নিয়ে সমতলে, অসমতলে অসম বহুভুজরূপ এলোমেলো খুঁটি পুঁতলেন, সাজালেন আর ধপাধপ পেরেক ঠুকলেন। এতে দেখা গেল– আড়ার কাঠ বেড়ায়, বেড়ার জানালা চালে, চালের ছাউনি বেড়ায় গিয়ে পৌঁছেছে– না হয়েছে ঘরের কর্ণ, না আছে বর্ণ, না ছিল ঘর গড়ার পূর্ব পরিকল্পনা, না ছিল ঘর-গড়া সম্পর্কে বিন্দুমাত্র পূর্বধারণা! জানেন কি, আপনি কী গড়লেন? গড়লেন কিম্ভূত-ঘর-গদ্যিকা! নিজেকেই এবার প্রশ্ন করুন, এই কর্মযজ্ঞে আপনি কি সত্যিকারের ঘরামি?
সার-ইঙ্গিত বোদ্ধা-পাঠক বুঝে গেছেন! আপনার সম্মুখে ঘরের উপাদান একটি রূপক মাত্র। উক্ত উপাদানকে ধরে নিন আপনার ভাষার বিশাল শব্দভাণ্ডার। অভিধান রচনা বাদে শব্দকে জড়ো করার মানেই কিন্তু কিছু গড়ে তোলা নয়। একে উপযুক্ত অর্থে, উপযুক্ত পরিমণ্ডলে, উপযুক্ত সৃজনশীল কবিভাষায় উপযুক্ত গাঁথুনিতে গেঁথে নিয়ে আপনার ভেতরকার বোধের স্রোতকে একটি ভাবের গভীরতায় স্থাপন করে সুনির্দিষ্ট ফ্রেমে জনসম্মুখে হাজির করতে পারলেই তা হয়ে উঠতে পারে এক পরম আস্বাদ্য কবিতা। এ জন্য শব্দের খেলায় এ ধরনের খেলোয়াড়কে বড় যোগ্য হয়ে উঠতে হয়। যোগ্য হয়ে উঠতে পারলেই আপনি ঘরামির রূপকে হয়ে উঠবেন একজন সত্যিকারের জাত কবি, সত্যিকারের সাহিত্যিক।
এতকিছুর পরেও অধুনা একদল লোক বলে বেড়ায়, কবিতা লিখতে আবার ছন্দ লাগে নাকি? তাদের বলছি- সাবধান; কবিতার সম্মান নিয়ে খেলবেন না। কারণ ছন্দ, কবিতার অনুষঙ্গ নয়, প্রধান অঙ্গ। ছন্দহীন রচনা কবিতা হয় না, আকারে বড় হলে হয় গদ্য, ছোট হলে হয় গদ্যিকা।
এই মর্মে অধ্যাপক ড. শঙ্খ ঘোষ বলেন, “ছন্দ, কবিতার প্রসাধনমাত্র নয়, সে যে কবির জীবনযাপনের এক বিশেষ প্রকাশ– এ কথা বিষ্ণু দে ভুলতে পারেন না কখনো। তিনি জানেন যে কবিতার এক অপরিবর্তনীয় শরীরই হলো ছন্দ। সেই কারণে তিনি ঈষৎ ধিক্কার দেন ডক্টর জিভাগোর সেই কাব্যতত্ত্বকে, যে-তত্ত্বের জের হিসেবে মনে হতে পারে যে ছন্দও যেন আপতিক, বহিরাঙ্গ মাত্র। জিভাগো, এ ছন্দে কবিতা লিখে পরে ‘আমূল সেই ছন্দ পাল্টান, গদ্যে যেমন পাল্টানো যায় শব্দ।’ বিষ্ণু দে তাই ঠাট্টা করে বলেন, “যেন ছন্দ কবিতার শুধু জামাকাপড়, কবিতার শরীর নয়, এ জামা ছেড়ে ও-জামা পরলেও চলে! না, তা চলে না, কারণ ছন্দই কবিতার শরীর।”বন্ধুর ছন্দের দুর্গে/ছন্দের বারান্দা/১০৬-২০৭ পৃষ্ঠা।
পৃথিবীর ইতিহাসে প্রচলিত সকল ভাষায় সর্বপ্রাচীন সাহিত্যস্বরূপ আমরা পেয়েছি স্বরারোপবৃত্ত ছন্দের কাঠামোয়– রসে অলঙ্কারে সুসজ্জিত গীতিময় ছন্দবন্ধ কাব্যগীতি। পাঠকের প্রশ্ন জাগতে পারে: স্বরারোপবৃত্তটা আবার কী? কিছুটা সুরের আশ্রয়ে ধ্বনির উচ্চারণ-কালের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটিয়ে সমগ্র বাক্যকে মাত্রাগত সমতায় নিয়ে আসার প্রবণতা বা কৌশলটাই মূলত সুরের ও স্বরের আরোপ: স্বরারোপবৃত্ত ছন্দ। সুনির্দিষ্ট পর্ববিভাগহীন এ ছন্দে বর্ণ, অক্ষর বা ধ্বনির সাধারণত দৃষ্টিগ্রাহ্য বা শ্রুতিগ্রাহ্য কোনোরূপ সমতার প্রয়োজন পড়ে না। ধ্বনির উচ্চারণে ব্যয়িত সময়টাই হয়ে ওঠে ছন্দরক্ষার মূল অস্ত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেকেই ছন্দ বলতে কেবল স্বরারোপবৃত্ত ছন্দ অর্থাৎ সাঙ্গিতিক ছন্দকেই বুঝতেন। যার রেশ ধরে তিনি প্রবোধচন্দ্র সেনের ছন্দসূত্র নির্ণয়ের প্রতি চরম বিরোধিতাও করেছিলেন। এ বিরোধী দলে সেকালের আরো অনেক গণ্যমান্যজন যোগ দিয়েছিলেন।
মূল কথায় ফিরে আসি। উপরিউক্ত ‘গদ্যকর্ম’ অংশে আপনি যে ঘর নির্মাণের স্বাধীন কর্মযজ্ঞ শেষ করে এলেন, সেটাই মূলত ওয়াল্ট হুইট ম্যান-সৃষ্ট বিশ্ব সাহিত্যের আরেকটি নতুন শাখা Petty Prose; ভাঙা চরণে লেখা ছোট গদ্য। ছোট আকারের এসব গদ্য দূর থেকে অনেকটা কবিতার মতো দেখালেও তা কিন্তু মোটেও কবিতা নয়; গদ্য তো গদ্যই। একজন সত্যিকারের সাহিত্যস্রষ্টাকে বুঝতে হবে যে, ছোট-বড় চরণে গদ্যকে সাজালেই তা কখনো কবিতা হয়ে যায় না– গদ্যই থাকে। প্রমাণ করতে চাইলে একে একটানা প্রবহমান চরণে সাজিয়ে দেখুন, গদ্যের প্রকৃত চেহারা নিজের সম্মুখেই হাজির হবে! টানা গদ্যে সাজালে এর অর্থেরও কোনো ঘাটতি পড়ে না; পাঠেও কোনোরূপ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয় না বরং যেমনটি ছিল ঠিক তেমন সাবলীলই থাকে। কারণ, ছোট গদ্য কবিভাষাসিদ্ধ রচনাই নয়: তা Petty Prose মাত্র। এ কথা সর্বজন গ্রাহ্য যে, ছোট নাটককে বলা হয় নাটিকা; ছোট পুস্তককে বলা হয় পুস্তিকা; ছোট পত্রকে যেমন বলা হয় পত্রিকা: তেমনি ওয়াল্ট হুইটম্যানের Petty Prose বা ছোট গদ্যকে গদ্যিকা বলাই যুক্তিযুক্ত। একটি ইতিহাস: বিশ্বসাহিত্যের এ নতুন শাখার উদ্ভাবক গদ্যিকর হুইটম্যান তাঁর জীবনের বিরাট একটি অংশ ব্যয় করেছিলেন ছন্দজ্ঞান অর্জনের পেছনে। কিন্তু কখনোই তিনি ছন্দ সাধনায় সফল হতে পারেননি। আজীবন ছন্দ তাঁকে ধরাই দেয়নি। তাঁর পক্ষে ইংরেজি ছন্দের Graphic Prosody, Musical Theory ও Acoustical Metrics এর কোনোটাই আয়ত্ব করার সক্ষমতা ছিল না। আরেকটি বড় কারণ এই যে, “প্রকৃত অর্থে হুইটম্যান কবি নন, তাঁর রচনা পদ্যপদবাচ্য নয়। তাঁর শিল্পক্ষমতার সীমাবদ্ধতার প্রধান কারণ আঙ্গিকের প্রতি তাঁর ঔদাসীন্য; মহত্তম সঙ্গীত সম্পর্কে তাঁর বোধশক্তির অভাব।” (ছন্দ-সমীক্ষণ’/আবদুল কাদির/৩০৭ পৃ.।) তারপরেও তাঁর এই নতুন সৃষ্টি Petty Prose অর্থাৎ ‘গদ্যিকা’ ভুলক্রমে হঠাৎ বাঙলা সাহিত্যে কবিতার মধ্যে ঢুকে পড়ল। এই ভুলের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ছান্দসিক আবদুল কাদিদের মন্তব্য স্মরণীয়: “তাতে বৈচিত্র্য ও বহুভঙ্গিমতা সৃষ্টির অবকাশ সীমিত; ফলে অচিরেই এই রীতির নিয়তি হতে পারে একঘেয়েমি ও ম্যানারিজম। ছন্দোজ্ঞানহীন দুর্বলের হাতে এই প্রণালীতে রচিত হবে শুধু অপকৃষ্ট পাঁচালী (doggerel), যেমন স্থুলশ্রুতি স্বল্পশক্তিমান লেখকের হাতে রচিত হবে গদ্য কবিতার নামে নিকৃষ্ট গদ্য (bad prose) এবং সাহিত্যের সেই জঞ্জালের বিরুদ্ধে এ দেশেও উচ্চারিত হবে সুধীজনের ধিক্কার।” সত্যিই কবিতার নামে গদ্যিকা চর্চা হওয়ার কারণে এর প্রতি বিশ্বব্যাপী অনেকেই চরম আপত্তির ঝড় তুলেছিলেন। টি এস এলিয়টের নির্মম ধিক্কার নিম্নরূপ:
“As for ‘free verse’ I expressed my view twenty-five years ago by saying that no verse is free for the man who wants to do a good job. No one has better cause to know than I, that a great deal of bad prose had been written under the name of free verse: though whether its authors wrote bad prose or bad verse, or bad verse in one style in another, seems to me a matter of indifference. But only a bad poet could welcome free verse as a liberation from form.” The Music of Poetry. Selected Prose. ৬৫ পৃষ্ঠা
ভাবার্থ: “Free Verse সম্পর্কে আমি পঁচিশ বছর আগে আমার দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছিলাম যে, যে কবি উৎকৃষ্ট কাব্য গড়তে চান তাঁর কাছে কোনো ছন্দই মুক্ত হতে পারে না; কেউই উপযুক্ত কারণ জানে না কেন Free Verse এর নামে প্রচুর বাজে গদ্য লেখা হয়েছে: যদিও এর লেখকরা খারাপ গদ্য লিখেছেন বা খারাপ পদ্য, বা খারাপ শ্লোক; আমার কাছে এসব চরম অযত্নের, উদাসীনতার বিষয়। কিন্তু কেবল একজন শক্তিহীন কবিই ফ্রি ভার্সকে ছন্দ কাঠামো থেকে মুক্তির পথ হিসেবে স্বাগত জানাতে পারেন।”
“গদ্যকবিতাকে একসময়ে অনেক মর্যাদা পেতে দেখেছি আমরা, কিন্তু আমাদের সাহিত্যে সে সাবালক হবার আগেই তার গৌরব অনেকটা হারাল। অনেকেই অবশ্য ভুল করে ভাবেন যে আজকের কবিতামাত্রেই গদ্যকবিতা। তাঁরা জানেন না যে আধুনিক কোনো কোনো কবি এই নূতন ছন্দরূপের প্রতি স্পষ্টতই বিমুখ। ছন্দের মুক্তিসাধনায় গদ্যকেই যদি ভাবি শেষ পরিণাম, তাহলে হয়তো সাম্প্রতিক এই বিরূপতায় আমরা দুঃখ পেতে পারি।” (ছন্দের বারান্দা/২৬ পৃ.) হ্যাঁ, এ ভবিষ্যৎবাণী সত্য; সে দুঃখ পাবার সময় যে চলছে এখন।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সাহিত্যের সর্বপ্রাচীন শাখাই হচ্ছে ছন্দাশ্রিত গীতিপ্রধান কবিতা। সেই ছন্দাশ্রিত কাব্যগুণ সমৃদ্ধ কবিভাষায় ছন্দবদ্ধ রচনাই কেবল কবিতার আখ্যা পাবার যোগ্য। একজন লেখককে স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে যে, ছন্দহীন রচনা কখনো কবিতা হয় না। হতে পারে না। কারণ গদ্যের সাথে কবিতার একমাত্র ব্যবধান তার কবিভাষা ও ছন্দে। আরেকটি সতর্ককথা বলে রাখছি– ছন্দবদ্ধ কোনো লেখায় যদি কাব্যগুণ না থাকে সেটাও কিন্তু কবিতা নয় বরং তা অনর্থক শব্দজটই বটে। সাহস করে বলতে হয় ‘গদ্যছন্দ’ শব্দটি ভুলক্রমে প্রচলিত হয়েছে সাহিত্যাঙ্গনে। আসলে গদ্যছন্দের স্বরূপ কী, ভিত্তি কী– আজ পর্যন্ত এর কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে কেউই দেননি, এমনকি দিতেও পারেননি। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থে ‘মেঘ’, ‘বৃষ্টি’ ও ‘খদ্যোৎ’ নামে তিনটি গদ্যিকা অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তবুও এ ধরনের সাহিত্য চর্চার উপযোগিতা সম্পর্কে তিনি বলেন, “কবিতাপুস্তকের ভিতর তিনটি গদ্য প্রবন্ধ সন্নিবেশিত হইয়াছে। কেন হইল, আমাকে জিজ্ঞাসা করিলে ভালো করিয়া বুঝাইতে পারিব না।” (ছন্দের ঘরবাড়ি/৫৮ পৃ.) মজার ব্যাপার ছিলো এটাই যে, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গদ্যিকার চর্চা করলেও তাকে কখনো কবিতা মনে করে চর্চা করেননি। এর পরিচয় তিনি ‘গদ্য প্রবন্ধ’ নামে দিয়ে গেছেন এবং তার স্বরূপ সম্পর্কে কেউ জানতে চাইলে তিনি কিছুই বলতে পারবেন না– এ কথাও অকপটে স্বীকার করে গেছেন।
হুইটম্যানের Petty Proseকে বঙ্কিমচন্দ্র কবিতা না ভাবলেও পরবর্তীকালে মতিভ্রমে কবিতা ভেবে বসলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যার ফলে তাঁর হাত ধরেই ভুলক্রমে গদ্যিকা ঢুকে পড়লো বাঙলা সাহিত্যের কবিতার ঘরে! যদিও তিনি চেয়েছিলেন ফরাসি কবি এজরা পাউন্ডের আদর্শে Vers libre অর্থাৎ মুক্তছন্দের চর্চা করবেন। কিন্তু তিনি নিজের বেখেয়ালে ওয়াল্ট হুইটম্যানকে ভেবেছিলেন এজরা পাউন্ডের সমান; এটাই তাঁর সবচেয়ে বড় বিভ্রান্তি ছিল। আবার তিনি চেয়েছিলেন তাঁর গদ্যছন্দের দলে সমকালে আরও কেউ ভিড় করুক। এই মর্মে মুজিবুল হক কবীর বলেন, “গদ্য কবিতার বিষয়টি যখন তাঁর মগজে ঘুরপাক খাচ্ছিলো, তখন তিনি ছন্দের যাদুকর সত্যেন্দ্রনাথকে এই প্রকরণ পরীক্ষার অনুরোধ জানিয়েছিলেন।” (ছন্দের ঘরবাড়ি/প্রবন্ধ: গদ্য কবিতা ও রবীন্দ্রনাথ; ৬১ পৃ.) কিন্তু তিনি রবি ঠাকুরের ডাকে সাড়া দেননি। কারণ, তিনি জানতেন যে, ছন্দের বাইরে কখনোই কবিতা গড়া সম্ভব নয়; এর কোনো ভবিষ্যৎও নেই। ছান্দসিক আবদুল কাদিরের মন্তব্য: “সোজা কথা, বিবিধ ছন্দরীতির প্রয়োগে কবিতার রূপ বহুধা হতে পারে। কিন্তু গদ্যকবিতার রীতি এরূপ নমনীয় নয় ও বহুমুখী নয়। (ছন্দ-সমীক্ষণ’ ৩০৬ পৃ.)
এ প্রসঙ্গে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মন্তব্য চরমভাবে উল্লেখযোগ্য: “মনে পড়ে একবার শ্রীমান্ সত্যেন্দ্রকে বলেছিলুম, ছন্দের রাজা তুমি, অ-ছন্দের শক্তিতে কাব্যের স্রোতকে তার বাঁধ ভেঙে প্রবাহিত করো দেখি! সত্যেনের মতো বিচিত্র ছন্দের স্রষ্টা বাংলায় খুব কমই আছে। হয় তো অভ্যাস তাঁর পথে বাধা দিয়েছিল, তাই তিনি আমার প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। আমি স্বয়ং এই কাব্য রচনায় চেষ্টা করেছিলুম লিপিকায়, অবশ্য পদ্যের মতো পদ ভেঙে দেখাইনি। লিপিকা লেখার পর বহুদিন আর গদ্যকাব্য লিখিনি। বোধ করি, সাহস হয়নি বলেই।” (ছন্দ/২৩৫ পৃ.)
হ্যাঁ, এটাই সত্য; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অল্প দিনের মধ্যেই গদ্যিকাকে কবিতা বলার সাহসই হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি অবশেষে নিজের ভুলও বুঝতে পেরে গদ্যিকা ছেড়ে পুনরায় কাব্যছন্দে আত্মনিয়োগ করলেন। এই মর্মে “ছন্দের বারান্দা” গ্রন্থের ১৫০ পৃষ্ঠায় শঙ্খ ঘোষ বলেন, “কয়েক বছর জুড়ে গদ্য ছন্দে লিখে যাবার পর কবি আবার ভর করেছিলেন ছন্দের উপর। কেবল ছন্দ বলাটাই যথেষ্ট হলো না, গদ্যছন্দকে প্রায় প্রত্যাখ্যান করে ফিরে এসেছিলেন তিনি।” এখানে আরেকটি কথা না বললেই নয় যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ভাষ্যমতে বাঙলা সাহিত্যে টেনে আনলেন “অ-ছন্দের” গদ্যিকা– সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে অনুরোধ করলেন “অ-ছন্দের শক্তিতে কাব্যের স্রোতকে” প্রবাহিত করতে– অথচ রবি ঠাকুরের গড়া সেই “অ-ছন্দের” গদ্যিকার মধ্যেও একদল লোক কেমন যেন এক ধরনের ছন্দ খুঁজে পান– ব্যাপারটা হাস্যকর নয় কি?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এজরা পাউন্ডের Vers libre ও হুইটম্যানের Petty prose বিষয়ে যে বিভ্রান্ত ছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর “বহুদিন আর গদ্যকাব্য লিখিনি। বোধ করি, সাহস হয়নি বলেই” উক্তিতে স্পষ্টরূপে প্রতীয়মাণ হয়েছে। এ কারণেই শ্রীবুদ্ধদেব বসুর (বাংলা ছন্দ/সাহিত্য চর্চা; বৈশাখ, ১৩৬১/ ১৩২ পৃ.) উক্তিতে স্পষ্ট হয়ে আছে যে, “এ-কথা নির্ভয়ে বলা যায় যে, কোনো ইংরেজ বা ফরাসির কাছে ফ্রি ভার্সের যা অর্থ, তা রবীন্দ্রনাথ রচনা করেননি। ওদের ফ্রি ভার্স প্রবোধচন্দ্রের মুক্তক নয়, গদ্যছন্দও নয়; ওদের ফ্রি ভার্স হলো মিশ্রছন্দ, যাতে একই কবিতায় একাধিক রকম ছন্দ স্থান পায়, কিংবা গদ্য-পদ্য মেশানো থাকে।” শ্রীশচন্দ্র দাশ তাঁর সাহিত্য-সন্দর্শন গ্রন্থে গদ্যিকার ভবিষ্যত সম্পর্কে ইঙ্গিত করেছিলেন: “আধুনিক পরীক্ষার যুগে, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলে, ইহা বাঁচিয়া যাইবে। কাজেই প্রতীক্ষা দ্বারা ইহার মূল্য যাচাই করিতে হইবে।” (১৭৫ পৃ.) আমার কাছে মনে হয়েছে, শ্রীশচন্দ্র দাশের বলা সেই ‘পরীক্ষা-প্রতীক্ষা’ দুইই শেষ হয়েছে এতদিনে এবং কবিতার নামে গদ্যচর্চা আজ কাব্যলোকে বড়ই অসহনীয় হয়ে উঠেছে। সবিশেষ বিচারে এতদিনে আমরা একটি মীমাংসায় উত্তীর্ণ হতে পেরেছি যে, কাব্যছন্দ, কবিভাষা কেবল কবিতার জন্য আর গদ্যভাষা গদ্যের জন্যই প্রযুক্ত। ‘গদ্যছন্দ’ নামটি ভিত্তিহীন; এরূপ ছন্দ কেবল লোকের মুখে মুখেই রয়েছে, বাস্তবে নেই। আর এমন যদি কিছু থেকেও থাকে কেউ দাবি করলে, আমি বলবো তা কেবল গদ্যের জন্যই সত্য; কবিতার জন্য নয়।
এতকিছুর পরেও গদ্যিকরগণ, কেউ হতাশ হবেন না। আশ্বস্ত করছি যে, যারা গদ্যিকা লিখছেন, লিখুন। বড় গদ্যের পাশাপাশি ছোট গদ্য অর্থাৎ ‘গদ্যিকা’ নামে স্বীকৃত সাহিত্যের এ নতুন শাখাটিকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলুন; যেহেতু ওয়াল্ট হুইটম্যান এ শাখাটির উদ্ভাবন করে গেছেন এবং বিশ্ব সাহিত্যকে করে গেছেন সমৃদ্ধ। এখন বোধকরি, সবার ভুল ভেঙে গেছে যে ‘গদ্যিকা’ আর ‘কবিতা’ সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্ট্যের সাহিত্যকর্ম। এখন বাঙলা সাহিত্যে গদ্যিকার অবস্থান অনেক উচ্চে এবং সম্ভাবনাময়, স্বপ্নময়, অর্থবহ। কারণ এর লেখক-পাঠক-শ্রোতা ও জনপ্রিয়তা বর্তমান সময়ে কবি ও কবিতার চেয়েও বেশি।
অবশেষে স্বীকার্য যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যদিও ভুলের বশবর্তী হয়ে ভিত্তিহীন গদ্যছন্দে কবিতার নামে গদ্যিকারই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন; নিরীক্ষার ফলস্বরূপ বছরখানেকের মধ্যেই তিনি নিজেকে সেই মর্মান্তিক ভুলের কব্জা থেকে গুটিয়েও নিলেন সত্য কিন্তু কবিতার জগতে গদ্যকে বিশ্বকবিকণ্ঠে হঠাৎ ‘গদ্যছন্দ’ বলার নিমিত্তে অসঙ্খ্য গদ্যিকর অজান্তেই এ অছন্দ গদ্যিকার চর্চা শুরু করলেন। যার ফলে, ওয়াল্ট হুইটম্যান থেকে ছিটকে এসে নতুন একটি শাখাও সংযুক্ত হলো বাঙলা সাহিত্যে; আর বাঙলা সাহিত্যে এ অভিনব শাখাটি সংযুক্তির বড় কৃতিত্ব যে রবি ঠাকুরেরই, যা চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। জয়; জয় হোক গদ্যিকার।
★বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ (অনার্স শাখা)
কাজী মন্টু কলেজ, কোটালিপাড়া, গোপালগঞ্জ; বাংলাদেশ
Discussion about this post