ড.শামিমা লিপি ও কিছু কথা-
—- মোঃ কামরুল ইসলাম।
গ্রামের মেঠো -মায়াবী পরিবেশে যে শৈশব,কৈশোর কাটিয়েছেন,সেই স্বপ্ন বুকে ধারন করে আগামীর ভাবনায় পথে পথে ছুটে চলেছেন দিক বিদিক,অসুস্থতা যাকে খানিকটা দাঁড়াতে দেয়নি,কবিতার জলে ছলছল যে মায়াবী মুখ যার সেই কবি ড.শামিমা লিপি।
তার কবিতায় প্রেম জ্বলেছিল,যে ছিল মায়ার এক স্রোতস্বিনী কর্ণফুলী। স্যার- আচ্ছালামু আলাইকুম কেমন আছেন- আমি শুনবো না আর কোন দিন।ঘর কন্যা থেকে ঘর সংসার এরপর কলম একাডেমি লন্ডন আমার প্রতি তাঁর অসম্ভব মায়াবী টান,শ্রদ্ধা ভালবাসা আমাকে কাঁদাবে অনন্ত কাল।
তিনি শুধু কবিতায় নয়-ছোট গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ- গবেষণা সাহিত্যের প্রতিটিতে শাখাতে ছিল তাঁর বিচরণ।পেয়েছেন অনেক পুরস্কার।
তিনি ১৫ অক্টোবর ১৯৭৮ সালে নওগাঁ জেলার মান্দা থানার দোসতিনা গ্রামে জম্মগ্রহন করেন।শামিমা লিপি বৈবাহিক সুত্রে ফেনী শহরে অবস্থান করতেন।তার একমাত্র সন্তান মাহদী বিন হোসাইন।তিনি রাজশাহী বিশ্ববদ্যালয় হতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স,মাস্টার্স করেন।তিনি এম ফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হতে।
আমরা জানি মৃত্যু সত্য ও বেদনা দায়ক।কুল্লু নাফসিন যাইক্বাতুল মাউত”- সুরা আল ইমরান, আয়াত ১৮৫ ।আমি পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত উল্লেখ করলাম যার অর্থ, “প্রত্যেক প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে।”
ধর্মকে দূরে রেখে মৃত্যুর আলোচনা করতে গেলে ধর্মে কি বলা হয়েছে তা জানা ভাল। সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ বিভিন্ন ধর্ম অনুসরণ করে আসছে ও সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করে আসছে।
সে ক্ষেত্রে মৃত্যু পরবর্তী জীবন প্রতিটি মানুষের জন্য এক রহস্যময় এবং একই সাথে এক অজানা ভয়।
প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করতো যে মৃত্যুর পর মানুষের আত্মাকে একটি নিক্তিতে মাপা হবে সেটিতে যদি পুণ্যের পরিমাণ বেশি হয় তাহলে তাকে একটি অদেখা শান্তিময় জগতে প্রবেশ করতে দেয়া হবে। কিন্তু পাপ বেশি হলে আত্মাটিকে একটি মস্ত রাক্ষস ‘চিবিয়ে চিবিয়ে’খেয়ে ফেলবে।
মিশরীয়দের এ বিশ্বাস মোটামুটি সকল প্রচলিত ধর্মের সারকথা। তবে সমাজে একটি শ্রেণীও আছে যারা মৃত্যু পরবর্তী জীবনে বিশ্বাস করে না।
মার্কিন দার্শনিক থমাস নেগেল মৃত্যুর ভয় নিয়ে এক অভিনব ব্যাখ্যা দিয়েছেন।তার মতে,মানুষ মৃত্যুপরবর্তী কী হবে সেজন্য মৃত্যুকে ভয় পায় না, বরং হঠাৎ মরে গেলে অনেক কিছু অসম্পূর্ণ থেকে যাবে,সে জন্য ভয় পায়।যেমন, একজন ড.শামিমা লিপি তার ছেলের লেখাপড়া,বেঁচে থাকা নিয়ে সব সময় আমার সাথে কথা বলতেন ও এ নিয়ে চিন্তায় থাকতেন।
তিনি সর্বদাই ভাবতেন এই ভেবে যে,আমার অবর্তমানে আমার ছেলে ভাল থাকবে -তো এই নিয়ে সব সময় ভয় ও চিন্তায মগ্ন থাকতো সে,সেই ক্ষেত্রে মৃত্যু নয়।
অন্যদিকে একজন লেখক,গবেষক তার অসমাপ্ত লেখা গবেষণা কাজের মাঝপথে কখনোই পৃথিবী ছেড়ে ওপারে চলে যেতে চায় না মুল কথা একজন ড.শামিমা লিপি ও একজন লেখক,গবেষক মৃত্যুকে সমীহ করে না বরং নিজেদের অসমাপ্ত কাজ নিয়েই তাঁরা অধিক চিন্তিত থাকেন।
সেদিক থেকে শামিমা লিপি চিন্তিত ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন কবি ও লেখক।আমাকে উপহার দেয়া তাঁর লেখা বই ‘বাংলাদেশে ভাসানী ন্যাপের রাজনীতি’ আমাকে দারুন ভাবে মুগ্ধ করেছিল।
আমাদের জীবনের কত রং,কত ঢং,কত সুখ আবার কত কষ্ট,কত পাওয়া না পাওয়া,মান,অভিমান কত অহমবোধ,কত রূপ,কত যৌবন,কত সনদ যদিও সব মিথ্যে,আমার মতে,একটি নির্ভেজাল চলনা….
সেই জীবন কাউ কে আগাম বার্তা জানান না দিয়ে মুহুর্তে শেষ হয়ে যায় সেই রং ও ঢং চলনাময় জীবনের চুড়ান্ত সমাপ্তিই হচ্ছে এক মাত্র মৃত্যু।
মৃত্যু হল একটি অবস্থা যখন সকল শারীরিক কর্মকাণ্ড যেমন শ্বসন,খাদ্য গ্রহণ,পরিচলন,ইত্যাদি ক্ষণিকে চিরতরে থেমে যায়।
মৃত্যুর সংবাদ শুনে আমরা, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাই হে রাজিউন, বলি আর তার মধ্যে দিয়ে আমরা ঐ মানুষটিকে আমরা চিরতরে ভুলে যাই এবং এই জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকার জন্য অবিরাম ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা আমাদের চলতেই থাকে।
মৃত দেহ চোখের সামনে থাকা অবস্থায় কত মুখরোচক খাবার পরিবেশন হয়, হাসি,ঠাট্টা,গল্প ঐ সময়ে বিরতি
হীন ভাবে চলতে থাকে হয়ত এর নাম জীবন।
মানুষের জীবন মৃত্যু নিয়ে ইসলামে বিশদ বনর্না দেয়া আছে। মানুষের মৃৃত্যু থেকে কিয়ামত বা পুনরুত্থান পর্যন্ত সময়কে ইসলামে বারযাখ নামে অভিহিত করা হয়।।মৃত্যু হচ্ছে কিয়ামত ও দুনিয়ার জীবনের মধ্যবর্তী একটি পর্দা। মানুষের মৃৃত্যুর পর আরেক জীবনের শুরু হয়।
পবিত্র কোরানে মহান আল্লাহ বলেন,”আর তাদের সামনে রয়েছে ‘বারযাখ’, যা পুনরুত্থান পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে। ” (সুরা মুমিনুন-১০০)
বারযাখ হলো কবরের জীবন।এটি আখিরাতের প্রথম পর্যায়।বারযাখ জীবনে মানুষ দুনিয়ার ভালো আমল ও খারাপ আমলের জন্য শান্তি ও শাস্তি ভোগ করবে।
ড. শামিমা লিপির মৃত্যু পরবর্তী নতুন জীবন সুখ শান্তিতে ভরে যাক।এই জীবনের সব অপ্রাপ্তি নতুন জীবনের সুখ,শান্তি আরাম আয়াসে ভরপুর থাকুক সে দোয়া থাকবে সব সময়।তিনি ছিলেন আমার অতি প্রিয় মানুষ।
পরিচয়ের পর সে আমাকে শুনিয়েছে তাঁর জীবনের অজানা সব গল্প।প্রথম পরিচয় হয় ফেনী শহর।আমাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেবে তার জন্য তিনি দীর্ঘক্ষণ হোটেল লবিতে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন।
অমায়িক,ভদ্র এক কথায় অসাধারণ মানুষ তিনি।আমি বার বার নিষেধ করার পর ও যে আমাকে স্যার ছাড়া কখনও অন্যভাবে সম্বোধন করেননি,অনুমতি না নিয়ে কখনও কথাও বলে নি।আমাকে শ্রদ্ধা জানাতে ও খুশি করতে প্রথম পরিচয়ের দিন তিনি তারঁ কন্ঠে হোটলে নাসরিন জেরিন সহ অনেকের উপস্থিতিতে ২ টি গান গেয়েছিলেন।তখনও তিনি অসুস্থ ছিলেন।২ টি গানের মধ্য ১ টি ছিল –
একদিন মাটির ভিতরে হবে ঘর,রে মন আমার, কেন বান্ধ দালান ঘর,রে মন আমার কেন বান্ধ দালান ঘর।
প্রাণ পাখি উড়ে যাবে পিঞ্জর ও ছেড়ে,ধরাধামে সবি রবে তুমি যাবে চলে….
এরপর ফেনীর সেই কালজয়ী দিঘীর পাড়ে আমার সাথে অনেক ছবি তুললেন।উনার স্বামীর ক্রয়কৃত বেদখল হওয়া সম্পত্তি এর করুন কাহিনী বনর্না করেন।তাঁর দেওয়া জমির কাগজপত্র এখনও আমার বাসায় আমার টেবিলের কোণে থেকে আজ কান্নার আওয়াজ তুলছে।
প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে যে নম্র করে,শান্ত করে তিনি তার জ্বলন্ত উদাহরন।আজ মনে হচ্ছে আমার জীবনে আসা এক উজ্জ্বল তারা না পাওয়ার বেদনা নিয়ে আকাশে মিলিয়ে গেল।এটি হয়ত আমার/আমাদের ব্যর্থতা।
যে কিছুদিন আগেও বলেছে,ভারতের চেন্নাই থেকে আসার পর স্যার আপনাকে প্রধান অতিথি করে আমি নওঁগা নিয়ে আসবো।আজ যখন ড্রয়িং রুমে বসে আমি দু একটি কথা লিখছি সবার অজান্তে আমার নেত্র বেয়ে টুপটুপ করে জল পড়ছে।এটি লিপির প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ।
আমি কাঁদছি,আমি মর্মাহত,আমি শোকাহত।
তাঁর জন্য দোয়া সব সময়।আজ মনে হচ্ছে মৃত্যুই মানব জীবনের সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞতা।মৃত্যুকে কেউ এড়িয়ে যেতে পারে না।মৃত্যু কখন কাকে গ্রাস করবে তা কেউ জানে না। জীবনের প্রবহমান খাতা যখন চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়,তখন সমবেদনা জানানো ছাড়া মানুষের আর কিছুই করার থাকেনা।
সেই ক্ষেত্রে হয়ত আমি ও অসহায়।
লেখক- কবি,প্রাবন্ধিক ও গনমাধ্যকর্মী।
Discussion about this post