মোঃ কামরুল ইসলামঃ
পদ্মা,মেঘনা,যমুনা বিধৌত বীর বাঙ্গালীর হাজার বছরের শ্রেষ্ট অর্জন আমার এই বাংলাদেশ।এই দেশ আমার মা,আমার জম্মভুমি। ইউনেস্কো ইয়ৎ ক্লাব অব চট্টগ্রামের পক্ষে ভারতের নয়া দিল্লীতে”Sharing information of Unesco movement” এই বিষয়ের উপর অনুষ্টিতব্য মত বিনিময় সভায় আমার অংশ গ্রহনের সৃযোগ হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল মত বিনিময় সভায় বা সেমিনারে অংশ গ্রহন,ভারতীয় মুসলমান শাসকদের প্রতিষ্ঠিত স্হাপত্য সচক্ষে দেখা মুসলমান দের গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া।
ইতিহাস শুধু অতীত ও বর্তমানের সেতু বন্ধনই নয় জাতির মেরুদন্ড ইতিহাস ও ঐতিহ্যের উপর নির্ভরশীল নিজকে সঠিক ভাবে বিকশিত করতে সুন্দর,সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য আমাদের যেমন ইতিহাস জানতে হবে তেমনি আগামী প্রজম্মকে জানাতে হবে।হৃদয়ের সকল অনুরণিত আবেগ,স্বপ্ন,পরিকল্পনা নিয়ে পথ চলতে চলতে আমি যখন খানিকটা অতৃপ্তিতে বিরক্ত তখনই ছিল ঐ সফর। প্রথমে চট্টগ্রামস্হ গরীবুল্লাহ শাহ মাজার সংলগ্ন চট্টগ্রাম – কলকাতা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে চেপে বসলাম।
এদিক ওদিক তাকাতে সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসল। রাস্তার দু পাশে গ্রাম আর গ্রাম অন্যদিকে গ্রাম্য গাছ গাছালীর সাথে বুনোলতার সখ্যতা দেখে হাসতে হাসতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি তা আমি টের ও পাইনি।এর মধ্যে ঢাকা হয়ে কলকাতা। যাএার পরের দিন ঘড়ির কাঁটা ছুঁই ছুঁই যখন পাঁচটা তখন পৌঁছলাম।
কলকাতা পৌঁছে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে ষ্টেশান থেকে আগ্রা- জয়পুর এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকেট নিয়ে রাত এগারটা পুনরায় ট্রেনে চেপে বসলাম। পরদিন মধ্য
রাতে আগ্রা রেলওয়ে ষ্টেশনে পৌঁছলাম এবং তাজমহল সংলগ্ন হোটেল মহারানী রেসিডেন্সে উঠলাম।রাতে হোটেলের ছাদে বসে আগ্রার তাজমহল অপরূপ দৃশ্য দেখে আমি সত্যিই মুগ্ধ হলাম। পরদিন টেক্সি ভাড়া করে প্রথমে সম্রাট আকবরের সমাধিস্হল সিকান্দারা এরপর একে একে আগ্রার দূর্গ,তাজমহল মতিলাল গার্ডেন সহ সব দর্শনীয় স্হান ঘুরে দেখলাম।
সম্রাট শাহজাহান ও মমতাজের শয়ন কক্ষ ও যে আসনে বসে শাহজাহান আগ্রার তাজমহল দেখতেন সে আসনে বসে নিজকে শাহজাহান ভেবে পাশে মৃত যমুনার দিকে উদাস নয়নে তাকিয়ে রইলাম।
ঐ মুহুর্তে আমার মনে হয়েছে তাজমহল স্মৃতি ভরাক্রান্ত সপ্তাচার্য নয়,আনন্দ বেদনায় আবেগে যমুনায় ডুবে থাকা স্বাদে গন্ধে এক অতুলনীয় নাটোরের কাঁচা গোল্লা।
কাঁচা গোল্লার স্বাদ নিতে নিতে আজমীরের উদ্দশ্যে স্টেশনে পৌঁছলাম তখন রাত ৮ টা। আজমীর এক্সপ্রেস যোগে যখন আজমীর পৌঁছলাম তখন ভোর পাঁচটা।তখন চারদিকে মুয়াজ্জিনের আজান শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষন অপেক্ষা করে সকালে জৃনায়েদ মিয়ান চিশতীর বাসভবন “সরদার মন্জিলে পৌঁছলাম।
সকল আনুষ্টানিকতা নামাজ,জিয়ারত শেষে পরদিন সকালে বিদেশী পর্যটকদের গাড়িতে চেপে সুন্দর নগরী রাজস্হানের উদ্দশ্যে রওয়ানা হলাম।যখন জয়পুর পৌছলাম তখন বেলা প্রায় ১টা। পুর্ব নির্ধারিত উৎসব প্যালেস নামক একটি হোটেলে উঠলাম।এর কিছুক্ষন পর হোটেল রিসেপশান থেকে জানানো হল যে জয়পুর ফিল্ম টানটার গাড়ি অপেক্ষা করছে।খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে নিচে নামলাম ও ফিল্ম টানটার গাড়িতে চেপে ওদের চলচিএ প্রশিক্ষন একাডেমী পরিদর্শন ও তাদের আতিথেয়তা মুগ্ধ হলাম।এর পর আমি দেখতে গেলাম হাওয়া মহল। উল্লখ্য হুমায়ুন পুএ আকবর অল্প বয়সে যখন পিতৃ হারা হন তখন বর্ণবাদী হিন্দুরা কৌশলে আকবরকে নিজদের আওতায় নিয়ে আসে।পরবর্তীতে আকবরের অভিভাবক বৈরাম খাঁ নিহত হওয়াই হিন্দুরা সুযোগটি লুপে নেয় ফলে মানসিংহের ফুফী জয়পুরী বেগমকে মাএ ১৯ বছর বয়সে সম্রাট আকবর বিয়ে করেন।পরবর্তীতে রাজপুএ জাহাঙ্গীর বিয়ে করেন মানসিংহের বোনকে এবং সম্রাট জাহাঙ্গীরের ছেলে খসরু বিয়ে করেন মানসিংহের কন্যাকে এইভাবে মানসিংহ এক সময়ে মোগল সেনা- পতি হন। আর হাওয়া মহল হচ্ছে মোগল সেনাপতি মানসিংহের তৎকালিন বাসভবন। এরপর একে একে জলমহল,যন্ত্ররমন্হর,বিড়লা মন্দির পিংক সিটি,এলব্রাট মিউজিয়াম,কনক গার্ডেন গোবিন্দ দেব,টেম্পল দেখে যখন হোটেলে ফিরলাম কখন প্রায় মধ্যরাত।পরদিন আকাশ পথে দিল্লী। যখন দিল্লী পৌঁছলাম তখন ঘড়ির কাটা প্রায় চারটা ছুঁই ছুঁই।নিউ দিল্লীতে হোটেল সান ইন্টারন্যাশনালে থাকার ব্যবস্হা হল। পরদিন পূর্ব নির্ধারিত সময়ে মত বিনিময় বা সেমিনারে অংশ গ্রহন করলাম।
USO হাউজের secretery general Aleumma join আমাকে সহ সবাইকে অর্ভ্যথনা জানালেন। সেমিনারে আমার বক্তব্যের সারমর্ম ছিল এই যে,দক্ষিন এশিয়ার প্রায় ২০০ কোটি মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে জলবায়ুর পরিবর্তন ও উন্নয়ন বিকাশে কাজ করা উচিত।
সেমিনার শেষে আয়োজকদের গাড়ি করে দিল্লী হার্ট,কুতুব মিনার,রাজঘাট,ঈশা খাঁ সমাধি,রাজলক্ষী মন্দির, ইন্ডিয়ান গেইট,প্রেসিডেন্ট ভবন,পার্লামেন্ট ভবন, নিজামউদ্দিন আউলিয়ার কবর,হুমায়ুন টমস্ দেখে যখন ফিরলাম তখন রাত প্রায় ২ টা।এরপর দিন দিল্লীর দুর্গ,দুর্গের ভিতর বিভিন্ন মোগল স্হাপত্য ও দিল্লী শাহী জামে মসজিদে নামাজ আদায় ও এর কারুকাজ সত্যি আমাকে মুগ্ধ করে।
এরপর দিন রাজধানী এক্সপ্রেস ট্রেনে কলকাতা হাওড়া স্টেশনের উদ্দশ্যে রওয়ানা হলাম। কিছুক্ষন পর দেখি একের পর এক রকমারি খাবার। আমি হিন্দি না জানলেও হঠাৎ বলেই ফেললাম — “খানা মে ঘরকা বানায় হুয়া,আপকে জরুর খিলে হোগা”– আমার এই কথা শুনে ট্রেনে সবাই হাসতে লাগল।গল্প করতে করতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন ৩ টা আমি হাওড়া স্টেশানে পৌঁছলাম। এর পর কলকাতা হয়ে বাংলাদেশ।বাংলাদেশে এসে মোগলদের স্হাপত্য,পরাজয়,শাসন আমল ভেবে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আর মনে হল ধর্ম, ভাষা,গোএ, বর্ণ ও সংস্কৃতি যে কোন জাতির সৃষ্টির প্রধান উপাদান যার অতীত, ঐতিহ্য ও সমকালীন বাস্তবতা বিভিন্ন সময়ে জাতি গড়া,নির্মানে ভুমিকা রাখে।
আজ ভারতীয়দের বর্তমান সামাজিক রীতি নীতি,শিক্ষা সঙ্গীত,অর্থনৈতিক অবস্হা মুসলমানদের শাসনের ফসল যা সম্রাট বাবরের বাবরনামা,আলভেরুনীর ভারত তত্ত্বে সুস্পষ্টভাবে বর্নিত আছে।
আজ সেই সাম্প্রদায়িক ভারতে কাশ্মীর সহ বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে মুসলমান নির্যাতিত হচ্ছে। যা কখন ও কাম্য নয়।
সেই তাজমহল আমাদের ভালোবাসার প্রতীক। সপ্তদশ শতকে মুঘল সম্রাট শাহজাহান তার প্রয়াত স্ত্রী মমতাজ কে ভালবেসে স্মৃতির উদ্দেশে গড়ে তোলেন রাজকীয় এই সমাধিস্তম্ভ। এটি ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র।প্রতি বছর এখানে প্রায় ৭০-৮০ লাখ ভ্রমণপিপাসু মানুষ ভিড় করে যার ফলে ভারত প্রতিবছর এই খাত হতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে।ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত মুঘল আমলের এই স্থাপনায় রয়েছে ইসলামিক, ফারসি ও ভারতীয় স্থাপত্যের এক অপূর্ব মিশ্রণ।২২ বছর ধরে ২০ হাজার শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরি হয় ঐতিহাসিক এই সমাধিস্তম্ভ।
মুলত সম্রাট শাহজাহানের তৃতীয় স্ত্রী ছিলেন মমতাজ মহল। বিয়ের আগে তার নাম ছিল আর্জুমান্দ বানো
বেগম আর সেই মমতাজ ১৪তম সন্তান জন্মদানের সময় ইন্তেকাল করেন। মমতাজ মহলের প্রকৃত সমাধিতে ক্যালিগ্রাফিক শিলালিপি হিসেবে আল্লাহর ৯৯ টি নাম রয়েছে।
জানা গেছে,তাজমহল নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করতে কাজে লাগানো হয়েছে প্রায় একহাজার হাতি। ভারতের পাঞ্জাব, রাজস্থান, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, চীন,তিব্বত ও আরব দেশ থেকে আনা হয়েছে তাজমহল নির্মাণের উপকরণ।
তাজমহলের গায়ে রয়েছে ২৮ ধরনের মূল্যবান রত্নের সমাবেশ।দিনের বিভিন্ন সময় ও পূর্ণিমা রাতে তাজমহল নানান রঙ ধারণ করে।তাজমহল কমপ্লেক্সে ঘোরাঘুরির সময় দেয়ালের পুরোটা জুড়ে কোরআনের বিভিন্ন আয়াত চোখে পড়বে,জনশ্রুতি রয়েছে,শাহজাহান কালো মার্বেল ব্যবহার করে আরেকটি তাজমহল বানাতে চেয়েছিলেন।
তবে ছেলেদের সঙ্গে শত্রুতার কারণে তা তিনি করতে পারেননি।আসুন শত্রুতা নয়,সবর্ত্র বন্ধুত্ব হোক,হোক ভালবাসা।
আপনি ও ইচ্ছে করলে তাজমহল ঘুরে আসতে পারেন।
লেখক-কবি, প্রাবন্ধিক ও গণমাধ্যমকর্মী।
Discussion about this post