প্রবাসী ও ঈদ এই দুটি শব্দে বিরাট তফাৎ খুজেঁ পাওয়া যায় প্রবাসীদের মাঝে। হাজার মাইল দূর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি দেওয়া প্রবাসীদের প্রবাস জীবন এবং ঈদ সুখেও যেন দুঃখে ভরা মন আর উদাসীনতায় সময় পার করা বৈকি।
ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ! এ কথা সবাই মানলেও, প্রবাসীদের জীবনে এর বাস্তবতা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। প্রবাসীদের ঈদ উদযাপন ভিন্নরকম। প্রবাসে অনেকেই আছেন যাদের জন্য ঈদের দিনটাও কষ্টকর।
মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদকে কেন্দ্র করে মানুষের প্রত্যাশা আর প্রস্তুতির কমতি থাকে না। একের পর এক ঈদ আসে যায়, প্রবাসীদের ঈদ রয়ে যায় নিঃসঙ্গতায় ভরা।
প্রবাসীদের ঈদ মানে মনে শত কষ্ট নিয়েও ‘হ্যাঁ, আমি ভালো আছি বলা। পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করা সত্যিই অন্য রকম আনন্দের। কিন্তু সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন প্রবাসীরা। দেশে ঈদ উদযাপন করা আর প্রবাসে উদযাপনের তফাৎ অনেক। কিন্তু পরিবারের হাল ধরতে এমন পরিস্থিতিকে মেনে নেন প্রবাসীরা। সচ্ছল হওয়ার তাগিদে প্রবাসে পাড়ি জমান তারা। এ কারণে জীবনের অনেক স্বাদ-আহ্লাদ ত্যাগ করেন প্রবাসীরা।
প্রবাস থেকে দেশের পরিবারের মাঝে ঈদ উৎসবে বরাবরে মতো সবরকম সুযোগ সুবিধা ব্যবস্থা করে দেওয়া হলেও নিজের সেই পুরানো পান্জাবী বা শার্ট/গেন্জি দিয়েও প্রবাসীরা অনেকে ঈদের নামাজ আদায় করে। নামাজের পর মনে দুঃখ রেখে ঠোঁটে হাসি মুখে পরিবারকে ভাব প্রকাশ করে খুব আনন্দে ঈদ উদযাপন করছি। আর সেই সব প্রবাসীদের মনে অসম দুঃখ রেখে ঈদে যদি কখনও বন্ধু বা আত্মীয় স্বজনদের সাথে ঈদ ভাগাভাগি করতে কোথাও ঘুরতে সুযোগ হয় যেন মরা ঢালে ফুল ফোটা বা শুকনা নদীতে হঠাৎ জোয়ার আসার মতো খুশিতে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠে।
এরই ধারাবাহিকতায় কিছু শারজাহ প্রবাসীদের ঈদ আনন্দে-আমিরাতের জাবেল জেইস ভ্রমণের বাস্তব চিত্র লেখার আজকের প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য লেখার প্রয়াস। এই রমাদানের ঈদের ৩য় দিন শনিবার বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার শারজাহস্থ শিল্প এলাকার বসবাসরত কিছু প্রবাসী বন্ধুদের পরামর্শ হলো যে রুমে আবদ্ধ না থেকে কোথাও একটু ঘুরতে যাওয়া আর এইসব ঈদ পবণে বাহিরে কোথাও ঘুরে আসলে ঈদের আনন্দ কিছুটা হলেও লাগব হবে। বন্ধুদের এমন তড়িৎ সিন্ধান্তে আমিরাতের সাত প্রদেশের অন্যতম প্রদেশ রাস আল খাইমা জাবেল জেইস ট্যুর করার সবার পছন্দ হয়। জাবেল জেইস হলো আমিরাত তথা বিশ্বের দীর্ঘ জিপলাইন। আকাঁবাকাঁ রাস্তা দিয়ে উপরে উঠেতে অনেক সময় লেখে যায়। হেঁটে উঠাতো সম্ভবপর নয় বরং গাড়ি ড্রাইভ করে পাহাড়ের উপরে উঠা অনেক দুস্কর হয়ে পড়ে।
রাস আল খাইমায় অবস্থিত জাবেল জেইস সর্ম্পকে একটু জেনে নেই। জেবেল জাইস বা জেইস ওমানের মুসান্দাম গভর্নরেট এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাস আল খাইমাহ – তে উত্তর – পশ্চিম হাজর রেঞ্জের একটি পর্বত । শিখরটির উচ্চতা ১৯৩৪ মিটার (৬৩৪৫ ফুট)। শিখরটি ওমানি দিকে অবস্থিত, তবে এই চূড়ার পশ্চিমে একটি উচ্চ বিন্দু সংযুক্ত আরব আমিরাতের সর্বোচ্চ বিন্দু হিসাবে বিবেচিত হয়, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১,৮৯২ মিটার (৬,২০৭ ফুট) উচ্চতায় এবং প্রায় ১০ মিটার বিশিষ্টতা। পর্বতের শিখরটি ওমানি দিকে জাবাল আর রাহরাহ এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জাবেল জেইস নামেই পরিচিত।
সকল বন্ধুদের পরামর্শ মতে ঈদের তৃতীয় দিন শনিবার সকাল সাড়ে নয়টায় রওনা হল দুই গাড়ি তথা এগার জনের কাফেলার লম্বা জার্নিং রাস আল খাইমা জাবেল জেইস এর উদ্দ্যেশে। আমিরাতের শেখ মোহাম্মদ যায়েদ রোডে একশ বিশ/ত্রিশ স্পিডে গাড়ি ড্রাইভ চালিয়ে বেলা প্রায় ১ টায় নাগাত জাবেল জেইসে গন্তব্যে পৌছেঁ যায় এগার জন বন্ধুদের কাফেলার দুই গাড়ির বহর।
উল্লেখ্য যে, শারজাহ থেকে রাস আল খাইমা যাওয়ার পথে হালকা জুস, চা- নাস্তা, ঈদের পুরোদমে আমোদ প্রমোদ এবং দুপুরের খাবারসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা হয়। জাবেল জেইসের নিচ থেকে নির্ধারিত সীমানায় গাড়ি ড্রাইভ করে পৌছঁতে প্রায় বিশ/পঁচিশ মিনিট সময় লাগে। অনেকে এই স্পটে নতুন বিধায় তাদের মধ্যে ভয়ও কাজ করছিল। যাহোক বেলা প্রায় ১ টার পর জাবেল জেইসে নির্ধারিত সীমানায় পৌছেঁ গাড়ি পার্কিং করার পর সকলের পরামর্শক্রমে পায়ে হেঁটে জাবেল জেইসের সর্বোচ্চ উপরে উঠতে ত্রিশ/পয়ত্রিশ মিনিট সময় লেগে যায় এবং পথিমধ্যে অনেকে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে অনেক কষ্ট করে উপরে উঠতে সক্ষম হয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, জাবেল জেইসের নিচে থেকে ঠিক উপর পর্যন্ত ১৭৭০ মিটারের আকাঁবাকাঁ রাস্তা যা সাধারণ মানুষের পক্ষে পায়ে হেঁটে উপরে উঠা খুবই দূরহ ব্যাপার। ঈদের খুশির জোয়ারে এই অসাধ্য সাধন করলেন শারজাহ থেকে আগত ওরা ১১জন বন্ধু এবং উপরে উঠে খুশিতে আত্নহারা হয়ে একজন আরেকজনকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। এখানে একটি বিষয় না বল্লে নয় যে পুরো সময় ধরে অন্য কোন পর্যটকের ঠিক উপরে উঠার সাহস হয়নি। অবশ্যই উপরে উঠার জন্য কর্তব্যরত ডিউটি পুলিশ অনেক সহায়তা করেছেন। উপরের এক স্থানে হেলিকাপ্টার এর জন্য মার্ক করে স্পট করে রাখা হয়েছে হয়ত কোন প্রাকৃতিক দূযোর্গ বা ডিফেন্স এর কোন প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয় পাহাড়ের ভিতরে এমন দৃশ্যটি সামনে থেকে দেখতেও খুবই চৎমকার দেখায়।
জাবেল জেইসের প্রায় চার ঘন্টা অবস্থানে দুপুরে খাবার খাওয়ার পর যার পছন্দমত ফটোসেশন বা ছবি তোলা এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করে এবং জাবেল জেইসের উপরে আরব আমিরাত এবং ওমানের বর্ডারের সিকিউরিটি ফোর্সের সাথেও কৌশলাদি বিনিময় হয়। যেখানে আমরা গাড়ি পার্কিং করেছিলাম সেখান থেকে উপরে পায়ে হেঁটে যেতে হয়েছে প্রায় ত্রিশ মিনিট এবং পথিমধ্যে আবার চার/পাঁচ মাইল স্থানীয় গাড়ি করে উপরে যেতে হয়েছে। সেখান থেকেও জাবেল জেইস পাহাড়ের শেষ পর্যন্ত দেখার পর্যটকদের তেমন দুঃসাহস হয় না বিধায় অনেকে জায়গাটি মিস করে। উপরে উঠতে পারলে মনে হয় জাবেল জেইসে আসা স্বার্থক হয়েছে। পাহাড়ের ঠিক উপর থেকে নিচের ভূমিতে থাকালে যেন মনে হয় নিচের বাড়ি ঘর এমনকি আরব সাগরও খুবই ক্ষুদ্রাকার। পাহাড়ের উপরের সবসময় ঠান্ডা ও জোড়ে হাওয়া বিরাজ করে বিশেষকরে ঠান্ডা মৌসুমে আদ্রতা জিরো ডিগ্রীর নিচে নেমে আসে। তখন ঐ সময়ে উপরের উঠার সম্ভবপর হয় না। যাহোক আমাদের নসিব ভালো যে এই সময় মৌসুমী বায়ু আমাদের অনুকুলে বিরাজ করেছিল।
জাবেল জেইস এর উপরে উঠতে স্থরে বিশেষ জায়গায় দর্শনার্থীদের জন্য গাড়ি পাকিং ও পিকনিক বা পাহাড়ের ভিউ দেখার স্থান করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এইভাবে যথই পাহাড়ে উপরে উঠা হয় তথই পাহাড়ের উপর থেকে নিচের ভিউ অনেক সৌন্দর্য রুপ ধারণ করে এবং আনন্দও লাগে পর্যটকদের। অনেক পর্যটক দূর দুরান্ত থেকে জাবেল জেইসে এসে রাত্রি যাপনও করে থাকে এবং সেখানে থাকার সেই পরিবশেও বিরাজ করে। উপরে যেখানে গাড়ি পার্কিং করার শেষ স্থান সেখানে থেকে আরেকটু উপরের কয়েকটি হোটেল আছে এবং সেই হোটেলে যেতে হলে আগে থেকে অনলাইনে বুকিং দিতে হয় তারপর নির্ধারিত গেইট দিয়ে হোটেলে যেতে হয়। হোটেল গুলোতে স্বশরীরের দেখলাম বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমিরাতে আসা পর্যটকদের ভীড় বেশি এবং পাহাড়ের উপরে এই ধরণের হোটেলে বসে নিচের ভিউ দেখতে ভ্রমন পীপাসুদের জন্য খুবই আনন্দায়ক পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে ঈদ মৌসুমে আমিরাতের সবজাগায় থেকে আসা স্থানীয় আরবী এবং প্রবাসীদের জাবেল জেইসে উপস্থিতি যেন তিল ধারণের ঠাঁই হয় না। ব্যাচেলর ও ফ্যামিলি নিয়ে আসা অনেক প্রবাসীরা নাস্তা, দুপুর ও রাতের খাবার নিয়ে আসেন এবং দীর্ঘসময় অবস্থান করে জাবেল জেইসের পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেখা যায়।
অবশেষে দীর্ঘসময় ধরে জাবেল জেইসে ফটোসেশন ও ঘুরাঘুরির ফাঁকে দুপুরের খাবার ও হালকা নাস্তা সেরে ঈদের আমেজে ১১ বন্ধুদের ঈদ উদযাপন ও আনন্দের বহিপ্রকাশ ঘটে। সন্ধ্যা প্রায় ৬টায় নাগাত আমরা জাবেল জেইস থেকে রাস আল খাইমা বীচ এরিয়া ভ্রমনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। পথিমধ্যে আমরা বৃষ্টির দেখা পাই যা গাড়ি থেকে উপভোগ করা হয়। ভ্রমনের সে সকাল ৯ টা থেকে সন্ধ্যা প্রায় ৮টার পর শারজাহ গন্তব্যস্থলে রওয়ানা হয়ে রাত ১০টায় নাগাত রাস আল খাইমা থেকে শারজায় আমাদের রুমে সবাই সুস্থ শরীরে এসে পৌছঁলে একদিনের ঈদ উদযাপনের পরিসমাপ্তি ঘটে আর এইভাবে ঈদের দিনটি সবার জন্য স্বরণীয় হয়ে থাকবে প্রবাস জীবনে।
প্রবন্ধ লেখক,
এম. শাহেদ সারওয়ার
দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত।
Discussion about this post