প্যানডেমিক ‘কোভিড-১৯’ বিশ্ব যুদ্ধের চেয়ে কম নয়। চলমান এ যুদ্ধে অনেকেরই সরাসরি মৃত্যু হয়েছে/হচ্ছে। তবে যেকোনো যুদ্ধকালীন সময়ে বড়দের চেয়ে ছোটদের ক্ষতি হয় বেশি।
বিশ্বের এ ক্রান্তিলগ্নে বড়দের চেয়ে ছোটদের মৃত্যুর আনুপাতিক হার কম তবে শিক্ষা খাত পঙ্গু হচ্ছে,শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে। সবাই সেটা বুঝি এবং বুঝেশুঝে সহ্য করছি।
উন্নত দেশগুলো অনলাইনে শিক্ষা-কার্যক্রম চালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও অনুন্নত দেশ একেবারে অক্ষম। গরিব দেশে এ ভয়াবহ পরিস্থিতিতে টানা লকডাউনে যেখানে অবিভাবকগণ অনেকেরই চাল-ডাল কেনার সামর্থ নেই ,সেখানে স্মার্টফোন কিনে ছেলেমেয়েদের কিভাবে অনলাইন ক্লাস করাবে?যে দেশে লোডশেডিং,মোবাইল নেটওয়ার্ক সমস্যার মতন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় প্রতিনিয়ত। সে দেশে অনলাইন ক্লাস মানে রীতিমতো হাস্যকর বিষয়। শুনে হয়তো আশ্চর্যান্বিত হবেন,মফস্বলে স্কুলগুলোর ছাত্র-ছাত্রীর অধিকাংশ অবিভাবক অনলাইন ক্লাস কি,সে বিষয়ে অবগত নন। তাহলে সরকারি- বেসরকারি সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাধারণ ছুটি ঘোষণার মাধ্যমে সময়সীমা বাড়ানো কোন যুক্তি খুঁজে পাই না।
গ্রামাঞ্চল খোলামেলা পরিবেশ হওয়ায় করোনা প্রাদুর্ভাব তেমন পরিলক্ষিত হয় না। এক্ষেত্রে অন্তত গ্রাম পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।
বাচ্চাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা এমনিতেই বড়দের চেয়ে বেশি,সেটাকে যদি আরেকটু বৃদ্ধি করাতে চান তাহলে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ান এবং নিজে খেয়ে বাঁচুন। এক খবর কাগজে দেখলাম,দিনাজপুর করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়ি বাড়ি ডিম পাঠিয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যান। এই ডিম দিতে গিয়ে তিনি নিশ্চয় হিমশিম খেয়েছেন,কারণ লকডাউনে এলাকা জুড়ে অভাব চলছে। আপনি যদি বিত্তবান শ্রেণির কেউ হয়ে থাকেন, আপনার এলাকায়ও অসহায় পরিবারে ডিম বা ফলফলাদি,না হয় পাউরুটি-বিস্কুট প্রদানের ব্যবস্থা করতে পারেন। এটি মানবসেবা।
এলাকা ভিত্তিক জরিপ চালিয়ে সরকার কিছু নিয়মনীতি বেঁধে দিয়ে স্কুল খুলে দিতে পারে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে অবনতি হলে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণে স্কুল বন্ধের ঘোষণা দিলেও তখন কারও আপত্তি থাকার কথা না,এখন যে সিদ্ধান্ত আরোপ করা হয়েছে তা ঢালাওভাবে করা হয়েছে।আমার যুক্তি হল,শরীরের ঘা বা ক্ষত যেখানে,ঔষধ সেখানেই লাগানো দরকার।
দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধের ফলে ধীরেধীরে ছেলেমেয়েরা পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়ে উঠছে এবং যাদের হাতে স্মার্টফোন রয়েছে তারা গেইমস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। আমার মনে হয় শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে,সুতরাং আজকের এ অসম্পূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা ভবিষ্যতের জন্য হুমকি স্বরূপ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিকই বলেছেন,”অসম্পূর্ণ শিক্ষায় আমাদের দৃষ্টি নষ্ট করিয়া দেয়—পরের দেশের ভালোটা তো শিখিতে পারিই না, নিজের দেশের ভালোটা দেখিবার শক্তি চলিয়া যায়।”
আমাদের অবিভাবকদের ভাববার উপযুক্ত সময় এসেছে এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়-গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ। আজকের প্রজন্ম শিক্ষা খাতে পঙ্গু হওয়া মানেই আগামীর স্বপ্নের বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়া। মোটকথা ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা ক্ষেত্রে পঙ্গুত্ব বরণ করতে দেয়া যাবে না। যেকোনো ভাবে হোক,তাদের শিক্ষা-কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। প্রয়োজনে শিক্ষা বাজেটে শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা বিল পাশ করা হোক। অন্যান্য খাতে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ হয়,তার সমপরিমাণ অংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করলে আগামীতে এ শিক্ষার্থীরা দেশ উন্নয়নে ভুমিকা রাখবে। শিক্ষামন্ত্রী যদি মনে করেন অনলাইনেই ক্লাস চলবে,তাহলে প্রতিটি শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক-শিক্ষিকার হাতে একটি করে বিনামূল্যে স্মার্টফোন কিংবা অনুরূপ কোন সিস্টেম তুলে দেন,যাতে পাঠদানে করোনা পরিস্থিতি কোন বাঁধা না হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে অনেককিছুই তো আবিস্কার হচ্ছে, অনলাইন ক্লাসের জন্য স্বল্প মূল্যের কোন প্রজেক্ট কি কেউ উপহার দিতে পারেন না?আমি মনে করি সরকারিভাবে উদ্যোগ নিলে সবকিছু সম্ভব। খাদ্য, বাসস্থান,বস্ত্রের পাশাপাশি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা যে আমাদের মৌলিক চাহিদা সেকথা আমরা ভুলতে বসেছি। আমাদের মনে থাকা উচিৎ, (Education is the backbone of a nation)-”শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড।”
লেখক-সাধারণ সম্পাদক,
‘কলম একাডেমী লন্ডন’-সংযুক্ত আরব আমিরাত চ্যাপ্টার।
Discussion about this post