মোঃ কামরুল ইসলামঃ
মানুষের প্রকৃতি প্রেম পৃথিবীকে অনন্ত সময় বাঁচিয়ে রাখতে পারে।প্রকৃতি থেকে আমরা যখন দূরে সরে যাই তখন আমরা নিজের ধ্বংস নিজেই ডেকে আনি সেই সঙ্গে পৃথিবীকে ধ্বংসে দিকে নিয়ে যাই।প্রকৃতি ছাড়া কখনও কোন মানুষ যেমন বাঁচে না,তেমনি মানুষ ছাড়াও এই প্রকৃতির কোন মূল্য নেই। প্রকৃতিকে ভালোবাসা মানে নিজে বেঁচে থাকা।তাই প্রকৃতির গাছপালা,পাহাড়, বন,নদী ও সমুদ্র সহ সব মুলত মানুষের কল্যাণে। প্রকৃতিতে যেখানে শতবর্ষী গাছ পালা থাকে,থাকে সবুজ বৃক্ষরাজি,পাখপাখালি,মানুষ অবসরে যেখানে গিয়ে প্রানভরে নিঃশ্বাস নেয়,নির্মল বায়ু গ্রহন করে,যার দৃষ্টি নন্দন নৈসর্গিক সৌন্দর্য প্রকৃতি প্রেমিক মানুষ সহ সকলকে নগর জীবনে খানিকটা স্বস্থি দেয়,সেখানে বেসরকারী হাসপাতাল সহ কোন স্থাপনা কোন অবস্থাতে প্রকৃতি প্রেমিক মানুষ সহ সকলের নিকট গ্রহন যোগ্য হতে পারে না ও মানুষের জন্য কখনও কল্যান বয়ে আনতে পারে না।
আমরা এখন যে চট্টগ্রাম শহরে বাস করি, এখানে সবুজ প্রকৃতি নেই, খেলার মাঠ নেই, বিকেলে প্রান ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গাও নেই,চট্টগ্রাম ষ্টেড়িয়াম নামে যে একটি মাঠ ছিল তার এক পাশে সুইমিং পোল নির্মান করায় স্কুল পড়ুয়া ছেলেদের খেলাধুলা সহ সাধারনের বিকেলে হাঁটাচলা ফেরা সংকুচিত হয়েছে। এই শহরে কোথাও ঘুঘু,শালিক সহ কোন পাখির আনাগোনা নজরে পড়ে না। প্রস্ফুটিত শাপলার সঙ্গে কিশোরীর লুকোচুরি খেলা এই শহরে কখনও হয়না। কোলাহলময় অথচ নির্জীব এই চট্টগ্রাম শহরে বাস করা এখন মানুষের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর,যন্ত্রণাদায়ক বটে।
তাই প্রকৃতির অতি নিকটে গিয়ে প্রকৃতিকে দেখা ও প্রান ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার একমাত্র স্হান চট্টগ্রামের সিআরবি।যাকে সবাই একবাক্যে চট্টগ্রামের ফুসফুস হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।এর চারদিকে সবুজের সমারোহ প্রাচীন শতবর্ষী গাছ গাছালি,পাহাড় বেষ্টিত অপরূপ নৈসর্গিক দৃষ্টি নন্দন এই স্হানটি সকলের নিকট একবাক্যে অতুলনীয়।
আজ হতে প্রায় দুইশত বছর আগে তৎকালীন উপনিবেশিক ভারতে ‘বেঙ্গল এন্ড আসাম রেলওয়ের’ সদর দপ্তর ভবন নির্মিত হয় এই চট্টগ্রামে। পাহাড়ঘেরা এক নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশ।কাল ক্রমে শতবর্ষী বৃক্ষ, চেনা,অচেনা পাখি আর বিশেষ করে বিকেলে সাধারন মানুষের কলতানে চট্টগ্রামের এই দৃষ্টিনন্দন স্থানটি
বা সবুজ বলয় টি প্রান ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার একমাত্র স্হান ভেবে চট্টগ্রামের মানুষরা এই স্হানটিকে অনেক আগে চট্টগ্রামের ফুসফুস হিসাবে আখ্যা দেয় আর এটি মুলত সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং বা সিআরবি নামে পরিচিত।
সমস্হ নিয়মের তোয়াক্কা না করে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এই দৃষ্টিনন্দন স্হানে একটি হাসপাতাল বানাতে চায়। চট্টগ্রামে একটি নয় অন্তত একডজন গুনগতমান সম্পন্ন সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতাল হোক তা চট্টগ্রামের মানুষ মনে প্রানে চায়,তবে সাধারন গরীব মানুষ যেন সহজে স্বাস্হ্যসেবা পায় এটি চট্টগ্রামের গণমানুষের দাবি।
বর্তমানে করোনা কাঁপছে আজকের এই পৃথিবী আর এই করোনাকালীন সময়ে চট্টগ্রামের মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে যে,চট্টগ্রামের স্বাস্হ্যখাত কত নাজুক যার ফলে সামান্য স্বাস্হ্য সমস্যায় দেখা দিলে যে কাউকে ঢাকা বা পাশ্চবর্তী দেশে যেতে হয়। আমরা জানি,চট্টগ্রামে রেলওয়ের অনেক পরিত্যক্ত জায়গা খালি পড়ে আছে,তাহলে সেখানে একটি নয় কয়েকটি হাসপাতাল করা যেতে পারে তা না করে যে জায়গা এসে মানুষ বুক ভরে শ্বাস নেয়,খানিকটা সবুজের সান্নিধ্য পায় সেখানে হাসপাতাল নয় তবে চট্টগ্রামের অন্যত্র কয়েকটি হাসপাতাল হোক এই যুক্তিক দাবিতে চট্টগ্রামের মানুষ আজ এক কাতারে সামিল হয়েছে।
যে পহেলা বৈশাখ প্রতিটি বাঙ্গালির হৃদয়ে আনন্দের জোয়ার বহে আনে,বিশ্ব কবি রবি ঠাকুরের কন্ঠে-“আজি প্রাতে সুর্য উঠা সফল হলো কার”।অন্য কোন এক কবির কন্ঠে যেন উচ্চারিত হয় বৈশাখী মেঘের কাছে জল চেয়ে তুমি কাঁদবে,আমি তা চাইনা।সেই নববর্ষ সহ বাঙ্গালির জাতির গুরুত্বপুর্ণ সামাজিক উৎসব প্রতিবছর এই সিআরবি তে সম্পন্ন হয়।
এটি একটি মুক্ত মঞ্চ।শুধু ১লা বৈশাখ নয, এখানে ১লা ফাল্গুন,নজরুল, রবীন্দ্র জয়ন্তী সহ সব ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড উদযাপিত হয়।গত কয়েক বছর ধরে চট্টগ্রামের ডিসি হিলে ১লা বৈশাখ সহ সব সাংকৃতিক কর্মকান্ড কর্তৃপক্ষ করতে না দেয়ায় সিআরবির শিরিষতলা হয়ে উঠছে সব মানুষের প্রানের
মিলন কেন্দ্র।
তাই আমাদেরকে সর্বপ্রথম পরিবেশকে বাঁচাতে হবে,এই মিলন কেন্দ্র সহ এর পরিবেশ রক্ষা করতে না পারলে পরিবেশের উপর এর প্রভাব পড়বে তাতে কোন সন্দেহ নেই কারন প্রতি বছর বাংলাদেশ নানা রকম প্রাকৃতিক দূর্যোগের কবলে পড়ে ও নানা রকম ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ঝড়, বৃষ্টি,বন্যা,পাহাড় ধ্বস, মানুষের মৃত্যু সহ সব দুর্যোগের মুল কারন সবুজ গাছপালা নিধন ও নির্বিচারে পরিবেশ ধ্বংসকরণ। আমরা দিনের পর দিন কোন না উন্নয়ন মুলক কর্মযজ্ঞের দোহাই দিয়ে সবুজ গাছপালা কেটে পরিবেশ ধ্বংস করছি যা আমাদের জন্য আমাদের পরবর্তী প্রজম্মের জন্য ভয়ংকর বার্তা বয়ে আনবে।
বর্তমান সময়ে লক্ষ্যনীয়,দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা,খরা সহ সব দুর্যোগের জন্য মুলত আমরা মানুষরা দায়ী।এটি মুলত আমাদের সমাজ ব্যবস্হায় সমাজের শিক্ষিত মানুষদের অসচেতনতার ফল তাই যথাযথভাবে পরিবেশ সংরক্ষণ করা এখন প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব হিসাবে গ্রহন করা উচিত।
আমাদের মনে রাখা উচিত,প্রকৃতি সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি এবং মানুষ ও মানবতার জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ ফলে প্রকৃতিকে সংরক্ষণ করা ও বেঁচে থাকার জন্য প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ আমাদেরকে ইবাদত হিসাবে মেনে
নিতে হবে।
কেননা প্রকৃতির অনুকূল পরিবেশ মানুষের জীবন ও অস্তিত্বের পক্ষে সহায়ক। সবুজের সমারোহে ব্যস্ততাময় জীবনে স্বপরিবারে মাঝেমাঝে খানিকটা বিশুদ্ধ নির্মল বাতাস গ্রহন,বুক ভরে শ্বাস প্রশ্বাস নেয়া, ফুসফুসের কার্যকারিতাকে সুদৃঢ় করে,সাথে বিশুদ্ধ পানি ও পর্যাপ্ত সুষম খাদ্য সুস্থ ও সুন্দর ভাবে মানুষকে দীর্ঘদিন বাঁচতে সহায়তা করে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ অপরিকল্পিত চিন্তা চেতনা ও তার বাস্তবায়ন লাগামহীন গাছপালা নিধন ও দূষণ মূলক কর্ম কান্ডের ফলে প্রতিনিয়তই ধ্বংস হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার সুন্দর মনোরম এই প্রকৃতি।
কেননা এই প্রকৃতির ও তার সবুজ নির্মল পরিবেশ আমাদেরকে নানাভাবে সাহায্য করে যেন পরিবেশ তার নিজের সবটুকু উজাড় করে মায়ের মত আমাদের লালন পালন করে অন্যদিকে আমরা সেই নির্মম স্বার্থপর মানুষ নিজের স্বার্থে নির্বিচারে পরিবেশকে ধ্বংস করছি যার ফলে প্রকৃতি আগামীতে দিন দিন আরো ভয়ানক রূপ ধারন করবে এর ফলে বাতাসে ক্ষতিকর কার্বন মনো অক্সাইডের পরিমান আরো বহুগুন বেড়ে যাবে,বর্তমানে বেড়ে যাওয়ায় লাগাম হীন ভাবে পৃথিবীর উষ্ণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সেই সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে পৃথিবীর আবহাওয়া। শুধু তাই নয়, পরিবেশ দূষণের ফলে জলজ প্রাণীদের জলে থাকতে ও এখন কষ্ট হচ্ছে তার কারণ পর্যাপ্ত পরিমাণে তারা অক্সিজেন পাচ্ছে না। উদ্ভিদরা সতেজ থাকতে পারছে না,বন জঙ্গল উজাড় হচ্ছে ফলে বাসস্থান সংকটে পড়ছে পাখি ও বন্য প্রানী সমুহ। এই সমস্ত কিছু পরিবর্তনের ফলে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ।
তাই সতর্কতা হিসাবে,গেল ২০০৭ সালের জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেলে বলা হয়েছিল ২০৫০ সালের মধ্যে বঙ্গপোসাগরের পানির উচ্চতা ১ মিটার পর্যন্ত বাড়বে এর ফলে মালদ্বীপ নামক দেশটা পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাবে।এমনকি বাংলাদেশের উপকূলের ১৭ শতাংশ ভূমি চলে যাবে সমুদ্র গর্ভে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে উপকূলীয় অঞ্চলের মাটিতে বাড়ছে লবনাক্ততা,এটি আরো বাড়বে।মাটির গভীরে পানির স্তর নেমে যাওয়াই বর্তমানে দেখা দিচ্ছে সর্বত্র সুপেয় পানির তীব্র সংকট।
ঋতু বৈচিত্র্যের ওপর পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে কেননা এখন যত্রতত্র গাছপালা নিধন অপরিকল্পিত নগরায়ন,বানিজ্যিক ভবন,পাঁচতারকা হোটেল,হাসপাতাল নির্মান সহ যাবতীয় কর্মযজ্ঞ এর অন্যতম উদাহরন।
আমরা জানি,একটি দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রোধ করার জন্য প্রয়োজন মোট ভূমির শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি।কিন্তু নির্মম হলেও সত্য বর্তমানে আমাদের দেশে মোট বন ভূমির পরিমান মাত্র প্রায় ১৬ ভাগ যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।তবে সরকারি হিসাব অনুযায়ী ৯ ভাগ এবং ওয়াল্ড রিচার্স ইনস্টিটিউট এর হিসাব অনুযায়ী ৫ ভাগ এবং দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ৩.৫ ভাগ।যার ফলে বাংলাদেশ আগামীতে সবচেয়ে মহা সংকটে ।তার খানিকটা নমুনা বর্তমানে সকলের নিকট লক্ষ্যনীয় যে,এখন আমাদের দেশে সময় মতো বৃষ্টি হয় না।প্রাকৃতিক অনিয়ম চলছে ফলে ঘূর্ণিঝড়,বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগে আছে।
তাই মানুষকে বাঁচাতে হলে সর্বপ্রথম পরিবেশকে বাঁচাতে হবে।পরিবেশ না বাঁচলে মানুষ বাঁচবে না।বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে পিপিপির আওতায় চট্টগ্রামের ফুসফুস উপর কংক্রিটের ১০০ আসনের মেডিকেল কলেজ,৫০ আসনের নার্সিং ইন্সটিটিউট,৫০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের অনুমোদন কোন অবস্থাতে গ্রহনযোগ্য নয়।এখানে বর্তমানে ভুগর্ভস্থ নলকুপ বসানো হয়েছে,আরো নলকুপ বসানো হবে তাতে ভুগর্ভস্থ পানির সংকট সহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিবে।প্রাকৃতিক সমস্যা সহ সব ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বন্ধ হয়ে যাবে।
চট্টগ্রামের মানুষ হাসপাতালের বিপক্ষে নয়।চট্টগ্রামে একটি নয়,কয়েকটি মান সম্মত হাসপাতালের প্রয়োজন রয়েছে।বর্তমান আন্দোলন কোন ব্যক্তি বা সংস্থা বা ব্যবস্হার বিরুদ্ধে নয় তবে তা ইতিহাস,ঐতিহ্য ও পরিবেশ রক্ষার।
এখানে ৬ একর জায়গা উপর প্রস্তাবিত হাসপাতাল বাস্তবায়িত হলে আরো অনেক বানিজ্যক স্থাপনা নির্মিত হবে শান্তিপুর্ন পরিবেশ পরবর্তিত হয়ে অশান্তিময় পরিবেশ সৃষ্টি হবে।তাহা ছাড়া রেলওয়ের আরো অনেক পরিত্যক্ত জায়গা খালি পড়ে আছে সেখানে হাসপাতাল নির্মিত হোক বর্তমানে তা চট্টগ্রামবাসির প্রানের দাবি।
প্রকৃতি ও ঐতিহ্য নষ্ট করে সিআরবিতে হাসপাতাল সহ বানিজ্যিক স্থাপনা নির্মান সত্যি বেদনা দায়ক।মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সিআরবি ও এর পরিবেশ নিয়ে কোন কারনে পুর্বে অবগত না থাকলে ও বর্তমানে তিনি অবগত।তাই চট্টগ্রামের মানুষের একমাত্র দাবি এই চুক্তিটি বাতিল হোক। চট্টগ্রামে একটি নয় অন্যত্র খালি জায়গা মানসম্মত আরো কয়েকটি হাসপাতাল নির্মিত হোক।
স্বাস্হ্য সেবার মান বৃদ্ধি কল্পে বেসরকারী খাত কে উৎসাহিত করতে দুর্নীতি,আগ্রাসন কে প্রশয় দিতে প্রকৃতি পরিবেশ ও চট্টগ্রামের ফুসফুসকে রক্তাক্ত করে হাসপাতাল নির্মান বন্ধ করা এখন চট্টগ্রামের মানুষের নৈতিক দায়িত্ব বটে।
লেখক-কবি, প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকারকর্মী।
Discussion about this post