অতিমাত্রায় আবেগ তাড়িত না হয়ে যে কোন সেলপি যেন সুন্দর জীবনের গতিময়তা ঠিক রাখে।
=======
বিশেষ ভঙ্গিতে,নিজ প্রয়োজনে নিজকে প্রচার করতে বা নিজের কর্মকান্ড অন্যকে জানান দিতে কেউ যখনই নিজের ডিজিটাল ক্যামেরায় নিজের বা অন্যকে সাথে
নিয়ে ছবি তুলে আমরা যখন আত্মতৃপ্তি বোধ করি
তখন আমার মতে তাকে সেলফি বলা যেতে পারে। একে সেলফি না বলে,বাংলায় নিজস্বী বললে হাস্যকর হবে তা মোটেই নয়।বিভিন্ন তথ্য হতে জানা যায়,সেলফি ১৮৩৯ সালে আবিস্কৃত হয়।
আমেরিকান ফটোগ্রাফার রবার্ট কর্ণলিউস ১৮৩৯ সালে নিজে নিজের ছবি বা সেলফি তুলেন আর তিনি ছবির পিছনে লিখেছিলেন.. .. The first Light Picture Ever taken যদিও আনুষ্ঠানিক ভাবে সেলফি তখন আবিস্কৃত হয়নি। এর বহু বছর পরে ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি selfie কে ইংরেজি শব্দ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়।যাই হোক,বর্তমানে ফিলিপাইনের মাকাটি সিটিকে “Selfi capital of the world ” বলা হয়। বিশ্বের সব চেয়ে বেশি সেলফি এই শহরে তোলা হয়।সেলফি তুলতে অনেকে পছন্দ করে তবে এটি একে বারেই খারাপ কিছু নয় বলে অনেকে মনে করেন। তবে
এতে আবেগ,পরিবেশ,পরিস্থিতি সব কিছুকেই গুরুত্ব দিতে হবে।জানা গেছে,পৃথিবীতে পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি সেলফি তুলে। ব্যাংককে ৫৫.২, নিউইয়র্কে ৬১.৬
আবার রাশিয়ার মস্কোতে ৮২ শতাংশ নারী।সেলফি তে নারীরা বেশি ব্যস্ত থাকে।
২০০৫ সালে এক কানাডিয়ান নাগরিক সেলফি ষ্টিকটি আবিস্কার করলে ও এই ষ্টিক টুলটি ২০১৫ সালের পর থেকে জনপ্রিয়তা পায় বলে ধারনা করা হয়। সেলফির
মাধ্যমে জীবনের সুন্দর কিছু মুহুর্তকেই স্মরণীয় করে
রাখা যায় তবে আমাদের এই সমাজ ব্যবস্থায় কাউকে সুন্দর পথের সন্ধান দিলে বা তার উপকার করলে তাকে পথ হাঁটতে শিখালে সে নিজকে পন্ডিত মনে করে তবে
যারা পথ হাঁটতে শিখায় সে শোকে কাতর হয় না,পাথর
হয়ে অন্যকে আবার পথ হাঁটতে শিখায়। ভালো কিছু ই
এখন কেউ দেখে না,পড়ে ও না।তাদের সময়ের স্বল্পতা।
মাথায় বেল করে পাশে সুন্দরী নিয়ে গাছতলার একটি
সেলফিতে লাইক,কমেন্টের শত হাজার বন্যা বয়ে যায়।
গত ২০১০ হতে নিজকে আধুনিক ও যুগের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমি সরব
থাকলে ও হাস্যকর,অর্থহীন ষ্ট্যাটাস কখন ও সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোষ্ট করিনি।
আমি সব সময় চেষ্টা করেছি শিক্ষা মুলক,জ্ঞানমুলক সাংগঠনিক,সচেতনতা বৃদ্ধি,সাহিত্যের হালচাল ও নানা সামাজিক অবক্ষয়,ইসলামিক জীবন বিধান ও করণীয়
পদক ও সম্মাননা প্রদানের আড়ালে নীরব বানিজ্য ও নানা সমাজিক অসঙ্গতির কথা উল্লেখ করে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করেছি।
বিভিন্ন সমাজিক আয়োজনে উপস্থিত হয়ে পারিবারিক ও আত্মীয়তার বন্ধনকে গাঢ় করতে জ্ঞানমুলক,শিক্ষা মুলক তথ্য পরিবেশন করে মানুষ,মানবিক মুল্যবোধকে জাগ্রত করার ও চেষ্টা করেছি।
আমি এখন ঢাকায় অবস্থান করছি,আমার গায়ে জ্বর আসছে দোয়া করবেন,আল বিদায়,আলহামদুলিল্লাহ
এ ধরনের হাস্যকর,অস্বাস্থ্যকর পোষ্ট থেকে সব সময় বিরত থেকেছি।
কে পছন্দ করলো বা কে শেয়ার করলো তা কখন ও ভেবে দেখি নি। মনের তাগিদে লিখি, ভালোলাগে তাই সময় স্বল্পতা,বিভিন্ন ব্যস্ততায় অল্প সময়ের জন্য আমি সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবেশ করি আর সুযোগ থাকলে আমি অন্যকে খেয়ালে রাখি,তার লিখনী হতে জানার ও চেষ্টা করি।আত্মঅহমিকা নয়,লাইক,কমেন্ট করার সুযোগ তেমন বেশি থাকে না বিধায় অপরাগতা
প্রকাশ করে সব সময় দুঃখ প্রকাশ করি।
অন্যদিকে বেরসিক হওয়ায় সেলপি তুলবো ভেবে ভেবে তুলতে পারি না,এই বয়সে সেলপি আমার জন্যে কতটা মানান সই এ ভেবে তোলা ও হয় না,এক কথায় আমি ব্যর্থ,পারি না।
করোনাকালীন সময়ে জীবনের প্রথম সেলপিকে ই এক কথায় স্মরনীয় করতে আমার এই লিখণী।যারা সেলফি তুলেন বা এই ধরনের কর্মকান্ডে আনন্দ পায় তাদের কে ও আমি কখনও বাঁকা চোখে দেখিনি।
অনেকের মতে,সেলফি এখন আর অভ্যাস নয়,মানসিক রোগে পরিণত হয়েছে। কেউ আজকাল ফোন কিনতে ই গেলে প্রথমে ফোনের ক্যামেরাতে সেলফি তোলার কল কবজা কতটা আধুনিক ও যুগোপযোগী তা যাচাই করে নেয়।
সেলফির জনপ্রিয়তা এখন শহর থেকে গ্রাম সর্বত্র।জনপ্রিয়তা একে বারে টুইটুম্বর।ছেলে,মেয়ে,দাদা,দাদী বৃদ্ধ সবাই ব্যস্ত সেলপি তুলতে।
বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বে ক্রমেই এর প্রবণতা বাড়ছে। অনেকে সেলপি তুলতে গিয়ে এমন বোকামির পরিচয় দিচ্ছে তারা ঐ মুহুর্তে অনেকের নিকট বিরক্তির কারন হয়ে দাড়াচ্ছে। আধুনিক পরিচয় দিতে গিয়ে বোকার পরিচয় নিজে বহন করছে।
নানা ভাবে সেলফি তোলা এবং এর মনস্তাত্তিক বিভিন্ন দিক নিয়ে বর্তমানে গবেষণা হচ্ছে।সমাজ বিজ্ঞানীদের
ও মনোবিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ এই সেলফি আমাদের নানা সমস্যায় দিন দিন আক্রান্ত করছে। সেলপি তুলে পোষ্ট দেওয়ার পর তাতে কে বা কারা লাইক বা কমেন্ট করছে তা নিয়ে পোষ্টদাতার যে উদ্বেগ,উৎকন্টা থাকে তা হতাশাজনক। অনেক সময় এই ধরনের কর্মকান্ডে অতি আপন মানুষের নিকট হতে কোন লাইক,কমেন্ট
না পেলে তার সাথে নানা ক্ষেত্রে সম্পর্কের অবনতির আশংকা থাকছে।দেখা হলে কথা হবে,পরিবার,জীবন, দেশ,রাজনীতি,অথর্নীতি সহ নানা বিষয়ের মত বিনিময় হবে তাতে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হবে।বর্তমানে সে ক্ষেত্রে সেলপি তোলার হিড়িক এক কথায় সুন্দর সময় কাটানো অনেক ক্ষেত্রে দুরূহ হয়ে পড়ছে।
অন্যদিকে সেলপি ম্যানের পোষ্টকৃত ছবিতে কেউ লাইক কমেন্ট না করলে তার আত্ম বিশ্বাস কমে যাচ্ছে বা সেই নিজে অসহায়ত্ব বোধ করছে যা তার ই মনস্তত্ত্বে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে।
অন্যের মনোযোগ তৈরীতে ব্যর্থ হয়ে সে নিজকে সমাজে অর্থহীন ভাবছে। মুলত সুন্দর,শিক্ষা মুলক,গঠন মুলুক
আলাপচারিতা যে কোন বন্ধনকে দৃঢ় করে সে ক্ষেত্রে স্মৃতি ধরে রাখতে একটি সেলপি তোলা ও যেতে পারে তবে সেলপি বা ছবি বন্ধুত্ব,পারিবারিক,আলাপচারিতা বা সম্পর্কের ক্ষেত্রে কখনও যেন প্রতিবন্ধকতা তৈরী না করে তাও খেয়াল রাখতে হবে।
জানা গেছে,সেলফি তুলতে গিয়ে বিশ্বে মৃত্যুর হার কোন অংশে নয়।পাশ্চবর্তী দেশ ভারতেই সব চেয়ে বেশি। বহু সেলফি প্রিয় তরুণ-তরুণী সেলফি তুলতে গিয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছে । তাহা ছাড়া বাংলাদেশে চলন্ত ট্রেনে নিজকে আধুনিক প্রমান করতে ও সেলপি তুলতে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কায় অনেকে মৃত্যু বরন করেছে।
২০১৪থেকে ২০১৬সাল পর্যন্ত একটি জরিপে দেখা যায় বিশ্বে ১২৭ জন সেলফি তুলতে গিয়ে প্রাণ হারায়। এর মধ্যে ভারতেই ৭৬ জন। মৃত্যু ঝুঁকি আছে জেনে ও তারা সেলফি তুলেছে যার ফলে মৃত্যু অবধারিত।
মনে রাখতে হবে,নিজকে পরিচয় করানোর এই মিথ্যেই প্রতিযোগীতা কখনো আধুনিকতা নয়।বিজ্ঞানের এ যুগে কোনটি ভালো কোনটি মন্দ তা বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন আজ আর নেই।
কি গ্রাম,শহর সকলের মন বন্দি থাকে আজ সামাজিক
যোগাযোগ মাধ্যমের রঙ্গিন পর্দায়। বাস্তবে এই সমাজে টাকার সমস্যায় অনেকে না খেয়ে থাকবে তবু ও তারা মুঠোফোনে এমবির জন্য টাকা ধার করতে ও প্রস্তুত।
তাদের এই ধরনের মানসিকতা কখনও মঙ্গলজনক নয়।আবেগ সব সময় অকল্যান বয়ে আনে এবং জ্ঞান শুন্যতা সৃষ্টির কারনে ভয়াবহ সমস্য তৈরী করতে পারে সে সব বিষয়ে আমাদেরকে সজাগ থাকতে হবে।
সেলপি কোন দেশের রাজনৈতিক,সমাজিক পরিবর্তন করতে পারে তা কিন্তু নয়।জাতীয় নির্বাচন,ভোটাধিকার গণতন্ত্র,মানবাধিকার ভিসানীতি সহ নানা বিষয়ে বন্ধুত্ব কে সেলফি গাঢ় করে তারই প্রমান ও ইতিমধ্যে পাওয়া যায়নি।
কে কত ক্ষমতাবান কারসাথে কার সম্পর্ক রয়েছে এবং ঐ সম্পর্ক কতটা গাঢ় তা প্রমানে অনেকে এ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেলপি তুলে পোষ্ট দেয় বা তা প্রচার করার জন্য অন্যদের মাধ্যমে তা জোর প্রচেষ্টা চালায়। কেউ জো বাইডেনের সাথে বা কেউ মন্ত্রীর সাথে,কেউ পুলিশ কর্মকর্তার সাথে কে কত ক্ষমতাবান তা প্রমানে
সবাই চেষ্টা করে।
মুলত সেলফি তোলার আসক্তি দিনেদিনে কঠিন সমস্যা রূপ নিচ্ছে। জানা যায়,বিভিন্ন প্রোগামে গিয়ে বা কার ও
সাথে তোলা বা নিজের অন্তত ৬টির বেশি সেলফি
সামাজিক মাধ্যমে আপলোড করার তাড়না যদি সে বোধ করে তখন বুঝতে হবে তার মানসিক সমস্যা হয়েছে এবং সে ‘ক্রনিক সেলফাইটিস’ নামে রোগে আক্রান্ত।
সেল্পি নিয়ে বর্তমানে একটি বিশেষ কোর্সে সকলের
পড়াশোনা করার সুযোগ থাকছে লন্ডন কলেজে।
‘দ্য আর্ট অব ফটোগ্রাফিক সেলফ-পোট্রেট’ নামের এ কোর্সে শিক্ষার্থীরা সেলফির নানা খুঁটিনাটি বিষয় তারা শিখতে পারবে এবং জানতে পারবে এবং সে শিক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি হিসেবে ও ধরা হবে বলে জানা যায়।
সেলফি তোলার সময় ঠিক কি কি বিষয় মাথায় রাখতে হবে,কত ধরনে সেলফি তুলতে বা কি উপায় অবলম্বন করে সেলফি তোলা যায় ও সেটিকে কিভাবে জনপ্রিয় করা যায় সে বিষয়ে ও প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।
কার কার সেল্পি প্রীতি রয়েছে বা এই প্রীতি কতটা ব্যক্তি বা পারিবারিক বা রাজনৈতিক জীবনে গুরুত্বপুর্ন তা ও জানা যাবে।ক্ষনিক তরে নিজকে আনন্দময় করতে ও স্মৃতিকে ধরে রাখতে এর গুরুত্ব থাকলে ও পারিবারিক
সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে এর কোন গুরুত্ব নাই
জীবন কে সুখের সাগরে ভাসিয়ে দিতে এই ধরনের কর্ম যজ্ঞ একেবারে মন্দ তা নয়।
এ ধরনের কর্মযজ্ঞ যেন আবেগকে অতিমাত্রায় তাড়িত না করে তা আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।
লেখক- মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম
কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক।
Discussion about this post